ত্বায়েফ সফর
চাচা আবু ত্বালিব ও স্ত্রী খাদীজার মৃত্যুর পর দশম নববী বর্ষের শাওয়াল মাস মোতাবেক ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে মে মাসের শেষে অথবা জুন মাসের প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহকে সাথে নিয়ে প্রধানতঃ নতুন সাহায্যকারীর সন্ধানে পদব্রজে(مَاشِيًا عَلَى قَدَمَيْهِ) ত্বায়েফ রওয়ানা হন।[যাদুল মা‘আদ ৩/২৮; ইবনু হিশাম ১/৪১৯; যঈফাহ হা/২৯৩৩] এ সময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ৫০ বছর। এই প্রৌঢ় বয়সে এই দীর্ঘ পথ প্রচন্ড গরমের মধ্যে তিনি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। যা ছিল মক্কা হতে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৯০ কি. মি. দূরে।
অতঃপর ত্বায়েফ পৌঁছে তিনি সেখানকার বনু ছাকবীফ গোত্রের তিন নেতা তিন সহোদর ভাই আব্দু ইয়ালীল, মাসঊদ ও হাবীব বিন আমর ছাক্বাফী-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। সাথে সাথে ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাদের প্রতি আহবান জানান। উক্ত তিন ভাইয়ের একজনের কাছে কুরায়েশ-এর অন্যতম গোত্র বনু জুমাহ(بنو جُمَح) এর একজন মহিলা বিবাহিতা ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৯)। সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই রাসূল (সাঃ) সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনজনই তাঁকে নিরাশ করেন। একজন বলেন,هُوَ يَمْرُطُ ثِيَابَ الْكَعْبَةِ (أى يُمَزِّقُهَا) إِنْ كَانَ اللهُ أَرْسَلَكَ ‘সে কা‘বার গোলাফ ছিঁড়ে ফেলবে, যদি আল্লাহ তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন’। অন্যজন বলেন,أَمَا وَجَدَ اللهُ أَحَدًا يُرْسِلُهُ غَيْرَكَ؟ ‘আল্লাহ কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে রাসূল হিসাবে পাঠানোর জন্য পাননি’?
তৃতীয় জন বলেন, والله لا أكلِّمُكَ أبدًا، إن كنتَ رسولاً لأنت أعظمُ خطرًا من أن أرُدَّ عليكَ الكلامَ، ولئن كنتَ تَكْذِبُ على الله ما ينبغى أن أُكلِّمَك ‘আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলব না। কেননা যদি তুমি সত্যিকারের নবী হও, তবে তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য হবে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আর যদি তুমি আল্লাহর নামে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে থাক, তবে তোমার সাথে আমার কথা বলা সমীচীন নয়’।[ইবনু হিশাম ১/৪১৯; আর-রাহীক্ব ১২৫ পৃঃ]
নেতাদের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে এবার তিনি অন্যদের কাছে দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু কেউ তার দাওয়াত কবুল করেনি। অবশেষে দশদিন পর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য পা বাড়ান। এমন সময় নেতাদের উস্কানীতে বোকা লোকেরা ও ছোকরার দল এসে তাঁকে ঘিরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ ও হৈ চৈ শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে তাঁকে লক্ষ্য করে তারা পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করে। যাতে তাঁর পায়ের গোড়ালী ফেটে রক্তে জুতা ভরে যায়’ (আর-রাওযুল উনুফ ৪/২৪)। এ সময় যায়েদ বিন হারেছাহ ঢালের মত থেকে রাসূল (সাঃ)-কে প্রস্তরবৃষ্টি থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এভাবে রক্তাক্ত দেহে তিন মাইল হেঁটে (আর-রাহীক্ব ১২৫ পৃঃ) তায়েফ শহরের বাইরে তিনি এক আঙ্গুর বাগিচায় ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় আশ্রয় নেন। তখন ছোকরার দল ফিরে যায়। বাগানটির মালিক ছিলেন মক্কার দুই নেতা উৎবা ও শায়বা বিন রাবী‘আহ দুই ভাই।[ইবনু হিশাম ১/৪২০; আল-বিদায়াহ ৩/১৩৪] এই উৎবার কন্যা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবা। যিনি ওহুদ যুদ্ধের দিন কাফের পক্ষে মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন এবং পরে মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।
ত্বায়েফ সফর বিষয়ে আয়েশা (রাঃ) বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ لِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا رَسُولَ اللهِ هَلْ أَتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أَشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ فَقَالَ لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ وَكَانَ أَشَدَّ مَا لَقِيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ الْعَقَبَةِ إِذْ عَرَضْتُ نَفْسِى عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ فَلَمْ يُجِبْنِى إِلَى مَا أَرَدْتُ فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِى فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلاَّ بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ فَرَفَعْتُ رَأْسِى فَإِذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلَّتْنِى فَنَظَرْتُ فَإِذَا فِيهَا جِبْرِيلُ فَنَادَانِى فَقَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الْجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ قَالَ فَنَادَانِى مَلَكُ الْجِبَالِ وَسَلَّمَ عَلَىَّ. ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّ اللهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ وَأَنَا مَلَكُ الْجِبَالِ وَقَدْ بَعَثَنِى رَبُّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِى بِأَمْرِكَ فَمَا شِئْتَ إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ. فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، متفق عليه-
‘তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন ওহুদের দিন অপেক্ষা কষ্টের দিন আপনার জীবনে এসেছিল কি? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমার কওমের কাছ থেকে যে কষ্ট পেয়েছি তার চাইতে সেটি অধিক কষ্টদায়ক ছিল। আর তা ছিল আক্বাবার (ত্বায়েফের) দিনের আঘাত। যেদিন আমি (ত্বায়েফের নেতা) ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল বিন ‘আব্দে কুলাল-এর কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে তাতে সাড়া দেয়নি। তখন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসার পথে ক্বারনুছ ছা‘আলিব (ক্বারনুল মানাযিল) নামক স্থানে পৌঁছার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। উপরের দিকে মাথা তুলে দেখলাম এক খন্ড মেঘ আমাকে ছায়া করে আছে। অতঃপর ভালভাবে লক্ষ্য করলে সেখানে জিবরীলকে দেখলাম। তিনি আমাকে সম্বোধন করে বললেন, আপনি আপনার কওমের নিকটে যে দাওয়াত দিয়েছেন এবং জবাবে তারা যা বলেছে, মহান আল্লাহ সবই শুনেছেন। এক্ষণে তিনি আপনার নিকটে ‘মালাকুল জিবাল’ (পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক) ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। ঐ লোকদের ব্যাপারে তাকে আপনি যা খুশী নির্দেশ দিতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, অতঃপর মালাকুল জিবাল আমাকে সালাম দিল এবং বলল, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ আপনার কওমের কথা শুনেছেন। আমি ‘মালাকুল জিবাল’। আপনার পালনকর্তা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি আমাকে যা খুশী নির্দেশ দিতে পারেন। আপনি চাইলে আমি ‘আখশাবাইন’ (মক্কার আবু কুবায়েস ও কু‘আইক্বা‘আন) পাহাড় দু’টিকে তাদের উপর চাপিয়ে দিব। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, বরং আমি আশা করি আল্লাহ তাদের ঔরসে এমন সন্তান জন্ম দিবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না’।[1]
উপরোক্ত হাদীছটি ব্যতীত ত্বায়েফ সফর সম্পর্কে কোন কিছুই সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে সেখানে যে তিনি মর্মান্তিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সে বিষয়ে উপরোক্ত হাদীছটিই যথেষ্ট। এজন্য কোন দুর্বল বর্ণনার প্রয়োজন নেই।
জিনদের ইসলাম গ্রহণ :
━━━━━━━━━━━━━━
ত্বায়েফ থেকে ফেরার পথে জিনেরা কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করে। জিনেরা দু’বার রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আসে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ১০ম নববী বর্ষে ত্বায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি ওকায বাজারের দিকে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় ফজরের সালাতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তখন জিনেরা সেই কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করল এবং তাদের জাতির কাছে ফিরে এসে বলল, হে আমাদের জাতি! إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا يَهْدِى إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ، وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا ‘আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)।[ইবনু হিশাম ১/৪২১-২২; বুখারী ফাৎহসহ হা/৪৯২১; মুসলিম হা/৪৪৯]
দ্বিতীয় বারের বিষয়ে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা সবাই মক্কার বাইরে রাত্রিকালে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। কিন্তু এক সময় তিনি হারিয়ে গেলেন। আমরা ভয় পেলাম তাঁকে জিনে উড়িয়ে নিয়ে গেল, নাকি কেউ অপহরণ করল। আমরা চারদিকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় রাত কাটালাম। রাতটি ছিল আমাদের জন্য খুবই ‘মন্দ রাত্রি’ (شَرُّ لَيْلَة)। সকালে তাঁকে আমরা হেরা পাহাড়ের দিক থেকে আসতে দেখলাম। অতঃপর তিনি আমাদের বললেন, জিনদের একজন প্রতিনিধি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে তাদেরকে কুরআন শুনালাম’। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং জিনদের নমুনা ও তাদের আগুনের চিহ্নসমূহ দেখালেন। অতঃপর বললেন, তোমরা শুকনা হাড্ডি ও গোবর ইস্তিঞ্জাকালে ব্যবহার করো না। এগুলি তোমাদের ভাই জিনদের খাদ্য’ (মুসলিম হা/৪৫০)। উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ কর্তৃক আবুদাঊদে বর্ণিত হাদীছে কয়লার কথাও বলা হয়েছে (আবুদাঊদ হা/৩৯)।
ত্বায়েফ সফরের ঘটনাবলীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলেন। অতঃপর ‘নাখলা’ উপত্যকায় পৌঁছে সেখানকার জনপদে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এখানেই জিনদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। যা সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে এবং সূরা জিন ১-১৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তবে জিনদের কুরআন শ্রবণ ও ইসলাম গ্রহণের কথা তিনি তখনই জানতে পারেননি। বরং পরে সূরা জিন নাযিলের পর জানতে পারেন। অতঃপর সূরা আহক্বাফ ৩২ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, কোন শক্তিই তার দাওয়াতকে বন্ধ করতে পারবে না। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَمَن لاَّ يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ أُوْلَئِكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয় না, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে সাহায্যকারীও পাবে না। বস্ত্ততঃ তারাই হল স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত’ (আহক্বাফ ৪৬/৩২)। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মনের মধ্যে আরও শক্তি অনুভব করেন।
নাখলা উপত্যকায় ফজরের সালাতে রাসূল (সাঃ)-এর কুরআন পাঠ শুনে নাছীবাইন (نصيبين) এলাকার নেতৃস্থানীয় জিনদের ৭ বা ৯জনের অনুসন্ধানী দলটি তাদের সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে যে রিপোর্ট দেয়, সেখানে বক্তব্যের শুরুতে তারা কুরআনের অলৌকিকত্বের কথা বলে। যেমন إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً- يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً ‘আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি’। ‘যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। অতঃপর আমরা তার উপরে ঈমান এনেছি এবং আমরা আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে কখনোই শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)। অতঃপর তারা বলে, وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَّنْ نُّعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُ هَرَبًا ‘আমরা নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে আমরা আল্লাহকে পরাজিত করতে পারব না এবং তাঁর থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারব না’ (জিন ৭২/১২)। সুহায়লী তাফসীরবিদগণের বরাতে বলেন, এই জিনগুলি ইহূদী ছিল। অতঃপর মুসলমান হয়’। এদের বক্তব্য এসেছে সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে’।[মুসলিম হা/৪৪৯; ইবনু হিশাম ১/৪২২; আর-রউযুল উনুফ ১/৩৫৪]
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) জিন ও ইনসানের নবী ছিলেন। বরং তিনি সকল সৃষ্ট জীবের নবী ছিলেন। যেমন তিনি বলেন, وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّوْنَ ‘আমি সকল সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে দিয়ে নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।[মুসলিম হা/৫২৩; মিশকাত হা/৫৭৪৮] অন্য হাদীছে সূরা সাবা ২৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَأَرْسَلَهُ إِلَى الْجِنِّ وَالْإِنْسِ ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেছেন’।[দারেমী হা/৪৬; মিশকাত হা/৫৭৭৩ সনদ সহীহ]
মক্কায় প্রত্যাবর্তন :
━━━━━━━━━━━
ক্বারনুল মানাযিলে মালাকুল জিবালের আগমন ও তার বক্তব্যে রাসূল (সাঃ)-এর মন থেকে ত্বায়েফের সকল দুঃখ-বেদনা মুছে যায়। তিনি পুনরায় মক্কায় ফিরে গিয়ে পূর্ণোদ্যমে দাওয়াতের কাজ শুরু করার সংকল্প করলেন। তখন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) বললেন, كَيْفَ تَدْخُلُ عَلَيْهِمْ وَقَدْ أَخْرَجُوك؟ ‘যে মক্কাবাসীরা আপনাকে বের করে দিয়েছে, সেখানে আপনি কিভাবে প্রবেশ করবেন? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, يَا زَيْدُ إنَّ اللهَ جَاعِلٌ لِمَا تَرَى فَرْجًا وَمَخْرَجًا وَإِنَّ اللهَ نَاصِرٌ دِينَهُ وَمُظْهِرٌ نَبِيَّهُ ‘হে যায়েদ! তুমি যে অবস্থা দেখছ, নিশ্চয়ই আল্লাহ এ থেকে পরিত্রাণের একটা পথ বের করে দেবেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দ্বীনকে সাহায্য করবেন ও তার নবীকে বিজয়ী করবেন’।[আর-রাহীক্ব ১২৮ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩০; ইবনু সা‘দ ১/১৬৫]
কুরায়েশদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা ও সেখানে দাওয়াতের নতুন কেন্দ্র স্থাপনের আশা নিয়ে রাসূল (সাঃ) এ সফর করেছিলেন। কিন্তু তারা সে দাওয়াত কবুল করেনি। বরং সেখান থেকে চরম নির্যাতিত হয়ে তাঁকে ফিরতে হয়।
ত্বায়েফের দিনকে সর্বাধিক দুঃখময় দিন বলার কারণ সম্ভবতঃ এই ছিল যে, ওহুদের ঘটনায় দান্দান মুবারক শহীদ হলেও সেদিন তাঁর সাথী মুজাহিদ ছিলেন অনেক, যারা তাঁর দাওয়াত চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু ওহুদের ঘটনার প্রায় ছয় বছর পূর্বে ত্বায়েফের সেই মর্মান্তিক ঘটনার দিন তাঁর সাথী কেউ ছিল না যায়েদ বিন হারেছাহ ব্যতীত। অতএব ত্বায়েফের ঘটনা ওহুদের ঘটনার চাইতে নিঃসন্দেহে অধিক কষ্টদায়ক ও অধিক হৃদয় বিদারক ছিল।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাখলা উপত্যকা হতে মক্কাভিমুখে রওয়ানা করে হেরা গুহার পাদদেশে পৌঁছে মক্কায় প্রবেশের জন্য কিছু হিতাকাংখীর নিকটে খবর পাঠালেন। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে চায়নি। অবশেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী রাজি হন এবং তার সম্মতিক্রমে যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় এসে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন ও হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করেন। এ সময় মুত্ব‘ইম ও তার পুত্র এবং কওমের লোকেরা সশস্ত্র অবস্থায় তাঁকে পাহারা দেন এবং পরে তাঁকে বাড়ীতে পৌঁছে দেন। আবু জাহল মুত্ব‘ইমকে প্রশ্ন করেন أمجير أو تَابِعٌ؟ ‘আশ্রয়দাতা না অনুসারী’? মুত্ব‘ইম জবাবে বলেন, بَلْ مُجِيرٌ ‘বরং আশ্রয়দাতা’। তখন আবু জাহল বলেন, قَدْ أَجَرْنَا مَنْ أَجَرْتَ ‘আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম, যাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ’। মূলতঃ এটি ছিল বংশীয় টান মাত্র। এভাবে মাসাধিককালের কষ্টকর সফর শেষে ১০ম নববী বর্ষের যুলক্বা‘দাহ মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথম দিকে তিনি মক্কায় ফিরে এলেন’।[আর-রাহীক্ব ১২৯-৩০ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩০]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর এই সৌজন্যের কথা কখনো ভুলেননি। এই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর সংঘটিত বদরের যুদ্ধে বন্দী কাফেরদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِىٍّ حَيًّا، ثُمَّ كَلَّمَنِى فِى هَؤُلاَءِ النَّتْنَى، لَتَرَكْتُهُمْ لَهُ ‘যদি মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী বেঁচে থাকত এবং এইসব দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুফারিশ করত, তাহলে তার খাতিরে আমি এদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম’।[বুখারী হা/৩১৩৯; মিশকাত হা/৩৯৬৫] মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী ৯০-এর অধিক বয়সে বদর যুদ্ধের পূর্বে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন (সিয়ারু আ‘লাম ৩/৯৮)।
ত্বায়েফ সফরের ফলাফল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) ত্বায়েফের এই সফরের ফলে মক্কার বাইরে প্রথম ইসলামের দাওয়াত প্রসারিত হয়।
(২) প্রায় ৬০ মাইলের এই দীর্ঘ পথে যাতায়াতকালে পথিমধ্যেকার জনপদ সমূহে দাওয়াত পৌঁছানো হয়। এতে নেতারা দাওয়াত কবুল না করলেও গরীব ও মযলূম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাড়া জাগে। ত্বায়েফের আঙ্গুর বাগিচার মালিকের ক্রীতদাস ‘আদ্দাস-এর ব্যাকুল অভিব্যক্তি ভবিষ্যৎ সমাজ বিপ্লবের অন্তর্দাহ ছিল বৈ কি!
(৩) এই সফরে কোন বাহ্যিক ফলাফল দেখা না গেলেও মালাকুল জিবাল-এর আগমন এবং সফর শেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে মক্কায় প্রবেশ ও সেখানে নিরাপদ অবস্থানের ফলে রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় যে, আল্লাহ তাঁর এই দাওয়াতকে অবশ্যই বিজয়ী করবেন। ফলে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহ লাভ করেন। অতএব রাসূল (সাঃ)-এর এ সফর ব্যর্থ হয়নি। বরং ভবিষ্যৎ বিজয়ের পথ সুগম করে।
[1]. মুসলিম হা/১৭৯৫; বুখারী হা/৩২৩১; মিশকাত হা/৫৮৪৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৪ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৫৯৮। উপরোক্ত হাদীছে ابْنُ عَبْدِ يَالِيلَএসেছে। কিন্তু জীবনীকারগণ عَبْدُ يَالِيلَ বলেছেন। তারা ‘আব্দু কুলাল-কে ‘আব্দু ইয়ালীল-এর ভাই বলেছেন, পিতা নন’। যার সঙ্গে রাসূল (সাঃ) কথা বলেছিলেন, তার নাম ছিল ‘আব্দু ইয়ালীল এবং তার পুত্রের নাম ছিল কিনানাহ। কেউ বলেছেন, মাসঊদ। কিনানাহ ইবনু ‘আব্দে ইয়ালীল ছিলেন ত্বায়েফের ছাক্বীফদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অন্যতম’ (ফাৎহুল বারী হা/৩২৩১-এর আলোচনা দ্রঃ)।