লালন-পালন
জন্মের পর শিশু মুহাম্মাদ কিছুদিন চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেন। তাঁর পূর্বে চাচা হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং তাঁর পরে আবু সালামাহ তার দুধ পান করেন।[আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬] ফলে তাঁরা সকলে পরস্পরে দুধভাই ছিলেন।
এ সময় পিতা আব্দুল্লাহ্র রেখে যাওয়া একমাত্র মুক্তদাসী উম্মে আয়মন রাসূল (সাঃ)-কে শৈশবে লালন-পালন করেন। এরপর ধাত্রী হালীমা সা‘দিয়াহ তাঁকে প্রতিপালন করেন। অতঃপর হালীমার গৃহ থেকে আসার পর মা আমেনা তাকে সাথে নিয়ে মদীনায় স্বামীর কবর যিয়ারত করতে যান এবং ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করলে কিশোরী উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফেরেন। পরে খাদীজা (রাঃ)-এর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ্র সাথে তার বিয়ে হয়। অতঃপর তার গর্ভে উসামা বিন যায়েদের জন্ম হয়। রাসূল (সাঃ) উম্মে আয়মানকে ‘মা’ (يَا أُمَّهْ) বলে সম্বোধন করতেন এবং নিজ পরিবারভুক্ত (بَقِيَّةُ أَهْلِ بَيْتِي) বলতেন। তিনি তাকে ‘মায়ের পরে মা’ (أُمِّي بَعْدَ أُمِّي) বলে সম্মানিত করতেন।[1]
সে সময়ে শহরবাসী আরবদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম ও সবল হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে পরিচিত বনু সা‘দ গোত্রের হালীমা সা‘দিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন। হালীমার গৃহে দু’বছর দুগ্ধপানকালীন সময়ে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তাদের ছাগপালে এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নেমে আসে। নিয়মানুযায়ী দু’বছর পরে বাচ্চাকে ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে মা আমেনার কাছে আনা হয়। কিন্তু হালীমা তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি আমেনাকে বারবার অনুরোধ করেন আরও কিছুদিন বাচ্চাকে তার কাছে রাখার জন্য। ঐ সময় মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। ফলে মা রাজি হয়ে যান এবং বাচ্চাকে পুনরায় হালীমার কাছে অর্পণ করেন (আর-রাহীক্ব ৫৬ পৃঃ)।
বক্ষ বিদারণ :
━━━━━━━━
দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন এবং বলেন,هَذَا حَظُّ الشَّيْطَانِ مِنْكَ ‘এটি তোমার মধ্যেকার শয়তানের অংশ’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। পুরা ব্যাপারটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালীমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে’।[2] হালীমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর দ্বিতীয়বার বক্ষবিদারণ হয় মি‘রাজে গমনের পূর্বে মক্কায়।[3]
আমেনার ইয়াছরিব গমন ও মৃত্যুবরণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
প্রাণাধিক সন্তানকে কাছে পেয়ে আমেনা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কবর যেয়ারত করার মনস্থ করেন। শ্বশুর আব্দুল মুত্ত্বালিব সব ব্যবস্থা করে দেন। সেমতে পুত্র মুহাম্মাদ ও পরিচারিকা উম্মে আয়মনকে সাথে নিয়ে তিনি মক্কা থেকে প্রায় ৪৬০ কিঃ মিঃ উত্তরে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর যথাসময়ে মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জা‘দীর পারিবারিক গোরস্থানে স্বামীর কবর যেয়ারত করেন। অতঃপর সেখানে এক মাস বিশ্রাম নেন। এরপর পুনরায় মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু কিছু দূর এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ‘আবওয়া’ (الأَبْوَاء) নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। যা বর্তমানে মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কিঃ মিঃ দূরে অবস্থিত একটি শহরের নাম। উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসেন। এভাবে জন্ম থেকে পিতৃহারা ইয়াতীম মুহাম্মাদ মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হলেন (ইবনু হিশাম ১/১৬৮)।
দাদার স্নেহনীড়ে মুহাম্মাদ :
━━━━━━━━━━━━━━━━
পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের স্নেহনীড়ে। আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজেও ছিলেন জন্ম থেকে ইয়াতীম। সেই শিশুকালের ইয়াতীম আব্দুল মুত্ত্বালিব আজ বৃদ্ধ বয়সে নিজ ইয়াতীম পৌত্রের অভিভাবক হন। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।
মাত্র দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতীজার যোগ্য অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন।[4]
কিশোর মুহাম্মাদ ও ব্যবসায় গমন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১০ বা ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি সর্বপ্রথম সিরিয়ার বুছরা (بُصْرَى) শহরে গমন করেন। সেখানে জিরজীস (جِرْجِيْس) ওরফে বাহীরা (بَحِيرَى) নামক জনৈক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাহেব অর্থাৎ খ্রিষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি মক্কার কাফেলাকে আন্তরিক আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন এবং কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে কাফেলা নেতা আবু ত্বালেবকে বলেন,هَذَا سَيِّدُ الْعَالَمِيْنَ هَذَا يَبْعَثُهُ اللهُ رَحْمَةً لِِّلْعَالَمِيْنَ ‘এই বালক বিশ্ব জাহানের নেতা। একে আল্লাহ বিশ্ব চরাচরের রহমত হিসাবে প্রেরণ করবেন’। আবু ত্বালেব বললেন, কিভাবে আপনি একথা বুঝলেন? তিনি বললেন, গিরিপথের অপর প্রান্ত থেকে যখন আপনাদের কাফেলা দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল, তখন আমি খেয়াল করলাম যে, সেখানে এমন কোন প্রস্তরখন্ড বা বৃক্ষ ছিল না, যে এই বালকের প্রতি সিজদায় পতিত হয়নি। আর নবী ব্যতীত এরা কাউকে সিজদা করে না। তাছাড়া মেঘ তাঁকে ছায়া করছিল। গাছ তার প্রতি নুইয়ে পড়ছিল। এতদ্ব্যতীত ‘মোহরে নবুঅত’ দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি, যা তার (বাম) স্কন্ধমূলে ছোট্ট ফলের আকৃতিতে উঁচু হয়ে আছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থে আখেরী নবীর এসব আলামত সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। অতএব হে আবু ত্বালেব! আপনি সত্বর একে মক্কায় পাঠিয়ে দিন। নইলে ইহূদীরা জানতে পারলে ওকে মেরে ফেলতে পারে’। অতঃপর চাচা তাকে কিছু গোলামের সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। এ সময় পাদ্রী তাকে পিঠা ও তৈল উপহার দেন।[5]
ইবনু ইসহাক বলেন, পাদ্রী বাহীরা তাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে লাত ও ‘উযযার দোহাই দিয়ে কিছু প্রশ্ন করেন। তখন তরুণ মুহাম্মাদ তাকে বলেন, আমাকে লাত ও ‘উযযার নামে কোন প্রশ্ন করবেন না। আল্লাহর কসম! আমি এদু’টির চাইতে কোন কিছুর প্রতি অধিক বিদ্বেষ পোষণ করি না। অতঃপর তিনি তাকে তার নিদ্রা, আচরণ-আকৃতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সেগুলিতে তিনি তাদের কিতাবে বর্ণিত গুণাবলীর সাথে মিল পান। অতঃপর তিনি আবু তালিবকে বলেন, ছেলেটি কে? আবু তালিব বলেন, এটি আমার বেটা। তিনি বললেন, না। এটি আপনার পুত্র নয়। এই ছেলের বাপ জীবিত থাকতে পারেন না। তখন আবু তালিব বললেন, এটি আমার ভাতিজা। বাহীরা বললেন, তার পিতা কি করেন? জবাবে আবু তালিব বলেন, তিনি মারা গেছেন এমতাবস্থায় যে তার মা গর্ভবতী ছিলেন। বাহীরা বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। আপনি ভাতিজাকে নিয়ে আপনার শহরে চলে যান এবং ইহূদীদের থেকে সাবধান থাকবেন। … আপনার ভাতিজার মহান মর্যাদা রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/১৮২)।
কিছু কিছু খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ এই ঘটনা থেকে নবী চরিত্রের উপরে অপবাদ দিতে চেষ্টা করেছেন যে, তিনি পাদ্রী বাহীরা-র নিকট থেকে তাওরাত শিখেছিলেন। যা থেকে তিনি কুরআন বর্ণনা করেছেন।[6] অথচ তখন তাওরাত বা ইনজীল আরবীতে অনূদিত হয়নি। তাছাড়া মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন ছিলেন মাত্র ১০/১২ বছরের বালক। যিনি মাতৃভাষা আরবীতেই লেখাপড়া জানতেন না (আনকাবুত ২৯/৪৮)। তিনি ও তাঁর বংশের সবাই ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। তাহলে কিভাবে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে তিনি পাদ্রীর নিকট থেকে তাওরাত শিখলেন, যা হিব্রু ভাষায় লিখিত। কিভাবে তিনি তার অর্থ বুঝলেন? অতঃপর সেগুলি কিভাবে সাক্ষাতের ২৮/৩০ বছর পর আরবীতে পরিবর্তন করে ‘কুরআন’ আকারে পেশ করলেন?
[1]. আল-ইছাবাহ, উম্মে আয়মন ক্রমিক সংখ্যা ১১৮৯৮; ঐ, আল-ইস্তী‘আবসহ (কায়রো ছাপা : ক্রমিক সংখ্যা ১১৪১, ১৩/১৭৭-৮০ পৃঃ, ১৩৯৭/১৯৭৭ খ্রিঃ)।
[2]. মুসলিম হা/১৬২, আনাস (রাঃ) হতে; মিশকাত হা/৫৮৫২ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[3]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ৩৪৯; মুসলিম হা/১৬৪, ১৬৩; মিশকাত হা/৫৮৬২, ৫৮৬৪, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. ইবনু হিশাম ১/২২৩, ২৩৫, ত্বাবাক্বাত ইবনে সা‘দ ১/১১৭-১৮। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭০)।
[5]. ইবনু হিশাম ১/১৮০-৮৩; তিরমিযী হা/৩৬২০; অত্র হাদীছে বেলালের সাথে তাঁকে মক্কায় ফেরৎ পাঠানোর কথা এসেছে, যেটা ‘মুনকার’ (منكر وغير محفوظ)। এ অংশটুকু বাদে হাদীছ সহীহ। আলবানী, মিশকাত হা/৫৯১৮ টীকা-১। রাযীন-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আলী (রাঃ) তাঁর পিতা আবু ত্বালিব সূত্রে বলেন যে, আমি তাকে একদল লোক সহ মক্কায় ফেরৎ পাঠাই, যাদের মধ্যে বেলাল ছিল’ (মিরক্বাত হা/৫৯১৮-এর আলোচনা)।
[6]. সীরাহ নববিইয়াহ সহীহাহ ১/১১০; গৃহীত : গোস্তাফ লুবূন, আরব সভ্যতা পৃঃ ১০২; মন্টোগোমারী ওয়াট, মক্কায় মুহাম্মাদ পৃঃ ৭৫।