মহানবী (সাঃ) জীবনী – মাক্কী জীবন – হিজরতকালের কিছু ঘটনা

One Time School

হিজরতকালের কিছু ঘটনা
(১) আবুবকর (রাঃ)-এর তাওরিয়া অবলম্বন(إتخاذ التورية لأبى بكر) : যাত্রাবস্থায় আবুবকর (রাঃ) সর্বদা সওয়ারীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিছনে বসতেন। কেননা আবুবকরের মধ্যে বার্ধক্যের নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা-ছূরতে তখনো চাকচিক্য বজায় ছিল। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরববী ভেবে আবুবকরকেই করতো। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন,هَذَا الرَّجُلُ يَهْدِينِى السَّبِيلَ ‘এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’ (বুখারী হা/৩৯১১)। এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন লোক হবে। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পরিচয় গোপন করতেন। আরবী অলংকার শাস্ত্রে এই দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যকে ‘তাওরিয়া’ (التوْرِيَة) বলা হয়। যাতে একদিকে সত্য বলা হয়। অন্যদিকে শ্রোতাকেও বুঝানো যায়।

(২) উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে(فى خيمة أم معبد) : খোযা‘আহ গোত্রের খ্যাতনাম্নী অতিথিপরায়ণ মহিলা উম্মে মা‘বাদের তাঁবুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পানাহারের কিছু আছে কি? ঐ মহিলার অভ্যাস ছিল তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন এমন হয়েছিল যে, বাড়ীতে পানাহারের মত কিছুই ছিল না। ঐ সময়টা ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। বকরীগুলো সব মাঠে নিয়ে গেছেন স্বামী আবু মা‘বাদ। একটা কৃশ দুর্বল বকরী যে মাঠে যাওয়ার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা তাঁবুর এক কোণে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেটাকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মে মা‘বাদ বললেন, ওর পালানে কিছু থাকলে তো আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বকরীটির বাঁটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখলেন ও বরকতের দো‘আ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরীটির পালান দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি দোহন করতে থাকলেন। তাতে দ্রুত পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথমে বাড়ীওয়ালী উম্মে মা‘বাদকে পান করালেন। তারপর সাথীদের এবং সবশেষে তিনি নিজে পান করলেন। এরপরে এক পাত্র পূর্ণ করে উম্মে মা‘বাদের কাছে রেখে তাঁরা পুনরায় যাত্রা করলেন।
অল্পক্ষণ পরেই আবু মা‘বাদ বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন- وَاللهِ هَذَا صَاحِبُ قُرَيْشٍ … لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَصْحَبَهُ وَلَأَفْعَلَنَّ إِنْ وَجَدْتُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আল্লাহর কসম! ইনিই কুরায়েশদের সেই মহান ব্যক্তি হবেন। যার সম্পর্কে লোকেরা নানা কথা বলে থাকে। … আমার দৃঢ় ইচ্ছা আমি তাঁর সাহচর্য লাভ করি এবং সুযোগ পেলে আমি তা অবশ্যই করব’।
আসমা বিনতে আবু বকর বলেন, আমরা জানতাম না রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোন পথে ইয়াছরিব গমন করেছেন। কিন্তু দেখা গেল যে, হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে জনৈক অদৃশ্য ব্যক্তি একটি কবিতা পাঠ করতে করতে এল এবং মানুষ তার পিছে পিছে চলছিল। তারা সবাই তার কবিতা শুনছিল। কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। এভাবে কবিতা বলতে বলতে মক্কার উচ্চভূমি দিয়ে আওয়াযটি বেরিয়ে চলে গেল। আর বারবার শোনা যাচ্ছিল لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। সেই সাথে পঠিত পাঁচ লাইন কবিতা শুনে আমরা বুঝেছিলাম যে, তিনি উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে অবতরণ করে ঐ পথ ধরে ইয়াছরিব গিয়েছেন। উক্ত বার্তায় কয়েক লাইন কবিতার প্রথম দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ।-
جَزَى اللهُ رَبُّ الْعَرْشِ خَيْرَ جَزَائِهِ + رَفِيقَيْنِ حَلاَّ خَيْمَتَيْ أُمِّ مَعْبَدٍ
هُمَا نَزَلاَ بِالْبِرِّ وَارْتَحَلاَ بِه + وَأَفْلَحَ مَنْ أَمْسَى رَفِيقَ مُحَمَّدِ
‘আরশের মালিক আল্লাহ তার সর্বোত্তম বদলা দান করেছেন তাঁর দুই বন্ধুকে, যারা উম্মে মা‘বাদের দুই তাঁবুতে অবতরণ করেছেন’।
‘তারা কল্যাণের সাথে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সাথে গমন করেছেন। তিনি সফলকাম হয়েছেন যিনি মুহাম্মাদের বন্ধু হয়েছেন’।[1] মূলতঃ আবুবকর পরিবারকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এলাহী বেতার বার্তা স্বরূপ। উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে অবতরণের ঘটনাটি ছিল সফরের দ্বিতীয় দিনের (আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)।

(৩) সুরাক্বা বিন মালেকের পশ্চাদ্ধাবন (سراقة في أثر الرسول صـ) : বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজী জনৈক ব্যক্তির কাছে মুহাম্মাদ গমনের সংবাদ শুনে পুরস্কারের লোভে দ্রুতগামী ঘোড়া ও তীর-ধনুক নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর পিছে ধাওয়া করল। কিন্তু কাছে যেতেই ঘোড়ার পা দেবে গিয়ে সে চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। তখন তীর ছুঁড়তে গিয়ে তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। ইতিমধ্যে মুহাম্মাদী কাফেলা অনেক দূরে চলে গেল। সে পুনরায় ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু এবারও একই অবস্থা হল। কাছে পৌঁছতেই ঘোড়ার পা পেট পর্যন্ত মাটিতে এমনভাবে দেবে গেল যে, তা আর উঠাতে পারে না। আবার সে তীর বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু আগের মতই ব্যর্থ হল। তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। তখনই তার মনে ভয় উপস্থিত হল এবং এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, মুহাম্মাদকে নাগালে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে নিরাপত্তা প্রার্থনা করল। এ আহবান শুনে মুহাম্মাদী কাফেলা থেমে গেল। সে কাছে গিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে কিছু খাদ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্র দিতে চাইল। রাসূল (সাঃ) কিছুই গ্রহণ করলেন না। সুরাক্বা বলল, আমাকে একটি ‘নিরাপত্তা নামা’(كِتَابُ أَمْنٍ) লিখে দিন। তখন রাসূল (সাঃ)-এর হুকুমে ‘আমের বিন ফুহায়রা একটি চামড়ার উপরে তা লিখে তার দিকে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর রওয়ানা হলেন।[বুখারী হা/৩৯০৬; ইবনু হিশাম ১/৪৮৯-৯০] লাভ হল এই যে, ফেরার পথে সুরাক্বা অন্যান্যদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যারা রাসূল (সাঃ)-এর পিছু নিয়েছিল। এভাবে দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল রক্ত পিপাসু দুশমন, দিনের শেষভাগে সেই হল দেহরক্ষী বন্ধু।
বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন, একদিন আমি আবুবকরকে জিজ্ঞেস করলাম, হিজরতের রাতে আপনারা কিভাবে সফর করেছিলেন, আমাকে একটু বলুন। তখন তিনি বললেন, আমরা সারা রাত চলে পরদিন দুপুরে জনমানবহীন রাস্তার পাশে একটা লম্বা ও বড় পাথরের ছায়ায় রাসূল (সাঃ)-কে শুইয়ে দিলাম। অতঃপর আমি চারিদিকে দেখতে লাগলাম। এমন সময় একটি মেষপাল আসতে দেখলাম। আমি মেষপালককে বললে সে দুগ্ধ দোহন করে দিল। অতঃপর আমরা উভয়ে দুধ পান করে তৃপ্ত হলাম। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে আমরা রওয়ানা হলাম। ইতিমধ্যে দূর থেকে দেখলাম সুরাক্বা বিন মালেক আমাদের পিছু নিয়েছে। তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর কাছে আসতেই তার ঘোড়া পেট পর্যন্ত শক্ত মাটিতে দেবে গেল। সে বলল, আমি দেখলাম তোমরা আমার বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছ। এক্ষণে আমার জন্য দো‘আ কর। আমি তোমাদের পক্ষে শত্রুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তখন রাসূল (সাঃ) তার জন্য দো‘আ করলেন এবং সে মুক্তি পেল। অতঃপর সে ফিরে যাওয়ার পথে পিছু ধাওয়াকারী লোকদের বলতে থাকে যে, ‘আমি তাকে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। অতএব তোমরাও ফিরে চল। এভাবে সে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়’।[2] এতে বুঝা যায় যে, উক্ত সান্ত্বনা বাক্যটি কেবল ছওর গিরিগুহায় নয়, অন্যত্র সংকট কালেও তিনি বলেছেন। ছওর গুহা থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে ঘটনাটি ঘটেছিল।

(৪) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সাথে সাক্ষাৎ(لقاء الزبير مع الرسول صــ) : পরবর্তী পর্যায়ে সাহাবী যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে ইয়াছরিব ফিরছিলেন। ইনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-কে এক সেট করে সাদা কাপড় প্রদান করেন (বুখারী হা/৩৯০৬)। যুবায়ের ছিলেন হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর বড় জামাতা ও আসমা (রাঃ)-এর স্বামী এবং ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহর অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মহাবীর সাহাবী ও আয়েশা (রাঃ)-এর পালিতপুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের স্বনামধন্য পিতা।

১ম জুম‘আ আদায় ও ইয়াছরিবে প্রবেশ (أداء الجمعة الأولى ودخول يثرب) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইয়াছরিবে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারকে সংবাদ দেন। বনু নাজ্জার ছিল খাযরাজ গোত্রভুক্ত। তারা এসে সশস্ত্র প্রহরায় তাঁকে সাথে নিয়ে ইয়াছরিবের পথে যাত্রা করেন। ক্বোবা থেকে ইয়াছরিবের মসজিদে নববীর দূরত্ব হল ১ ফারসাখ (ফাৎহুল বারী হা/৩৯০৬-এর আলোচনা) তথা ৩ মাইল বা ৫ কি.মি.।
বনু নাজ্জারকে রাসূল (সাঃ)-এর মাতৃকুল বলার কারণ এই যে, রাসূল (সাঃ)-এর প্রপিতামহ হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ এই গোত্রে বিবাহ করেছিলেন। সেকারণ মদীনাবাসীগণ মক্কার বনু হাশেমকে তাদের ‘ভাগিনার গোষ্ঠী’ (إِبْنُ أُخْتِنَا) বলে অভিহিত করতেন (ইবনু হিশাম ১/১৩৭ টীকা -২)।
ইয়াছরিবের উপকণ্ঠে পৌঁছে বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رَانُونَاء) উপত্যকায় তিনি ১ম জুম‘আর সালাত আদায় করেন। যাতে একশত জন মুছল্লী শরীক হন।[3] এটাই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর আদায়কৃত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুম‘আ। কেননা হিজরতের পূর্বে মদীনার আনছারগণ আপোষে পরামর্শক্রমে ইহূদী ও নাছারাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনের বিপরীতে নিজেদের জন্য একটি ইবাদতের দিন ধার্য করেন ও সেমতে আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মদীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের ‘নাক্বী‘উল খাযেমাত’ (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর সালাত চালু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুছল্লী অংশগ্রহণ করেন।[ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ সনদ ‘হাসান’। ইবনু হিশাম ১/৪৩৫; যাদুল মা‘আদ ১/৩৬১; মির‘আত ৪/৪২০]
জুম‘আ পড়ে রাসূল (সাঃ) পুনরায় যাত্রা করে দক্ষিণ দিক থেকে ইয়াছরিবে প্রবেশ করেন। এদিন ছিল ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার (আর-রাহীক্ব ১৮৪ পৃঃ)। ইয়াছরিবের শত শত মানুষ তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। বহু পুরুষ ও নারী বাড়ী-ঘরের ছাদের উপরে আরোহন করেন। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, هَذَا رَسُولُ اللهِ قَدْ جَاءَ (এই যে, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন (বুখারী হা/৪৯৪১ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)। جَاءَ نَبِىُّ اللهِ، جَاءَ نَبِىُّ اللهِ (এই যে, আল্লাহর নবী এসে গেছেন (বুখারী হা/৩৯১১)। يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ يَا مُحَمَّدُ يَا رَسُولَ اللهِ (হে মুহাম্মাদ! হে আল্লাহর রাসূল!-মুসলিম হা/২০০৯)। প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবী বারা বিন ‘আযেব আনছারী (রাঃ) বলেন, فَمَا رَأَيْتُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ فَرِحُوا بِشَىْءٍ فَرَحَهُمْ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (সাঃ)-এর আগমনে আমি মদীনাবাসীকে যত খুশী হতে দেখেছি, এত খুশী তাদের কখনো হতে দেখিনি’ (বুখারী হা/৩৯২৫)। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর আগমনের দিনের চেয়ে অধিক সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল দিন আর কখনো দেখিনি। আনন্দে উচ্ছ্বসিত মানুষ ঐদিন থেকে তাদের শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘মদীনাতুর রাসূল’ (রাসূলের শহর) বা সংক্ষেপে ‘মদীনা’।[বুখারী হা/১৮৭১; মুসলিম হা/১৩৮২]
ইয়াছরিবে প্রবেশের পর প্রত্যেক বাড়ীওয়ালা তার বাড়ীতে রাসূল (সাঃ)-কে মেহমান হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে উটের লাগাম ধরে টানতে থাকে। কিন্তু রাসূল (সাঃ) বলতে থাকেন, তোমরা ওকে ছাড়। কেননা সে আদেশপ্রাপ্ত’ (دَعُوهَا فَإِنَّهَا مَأْمُورَةٌ)। অতঃপর উষ্ট্রী নিজের গতিতে চলে বর্তমানের মসজিদে নববীর দরজার স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু রাসূল (সাঃ) নামেননি। পরে উষ্ট্রী পুনরায় উঠে কিছু দূর গিয়ে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে এসে বসে পড়ে। এটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের মহললা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চেয়েছিলেন এখানে অবতরণ করে তার মাতুল বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে। আল্লাহ তার সে আশা পূরণ করে দেন। এখন বনু নাজ্জার গোত্রের লোকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গেল কে রাসূলকে আগে তার বাড়ীতে নিবে। আবু আইয়ূব আনছারী উষ্ট্রীর পিঠ থেকে পালান উঠিয়ে নিজ বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ওদিকে আক্বাবাহর প্রথম বায়‘আতকারী আস‘আদ বিন যুরারাহ উটের লাগাম ধরে রইলেন। কেউ দাবী ছাড়তে চান না।[4]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫১-৫২; হাকেম হা/৪২৭৪, ৩/৯-১০ পৃঃ, হাকেম সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন; হাকেমে ১৬ লাইনের কবিতা এসেছে। দ্বিতীয় লাইন থেকে কিছু শাব্দিক পরিবর্তন আছে। মিশকাত হা/৫৯৪৩ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ; ফিক্বহুস সীরাহ ১৬৮ পৃঃ, আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন; সীরাহ সহীহাহ ১/২১২-১৫।
[2]. বুখারী হা/৩৬১৫; মুসলিম হা/২০০৯; মিশকাত হা/৫৮৬৯ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ। (ক) এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, সুরাক্বা বিন মালেক যখন তার রাবেগ এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমার অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন তোমার হাতে কিসরার মূল্যবান কংকন পরানো হবে? এ বক্তব্যটির সনদ মুরসাল বা যঈফ (মা শা-‘আ ৮৫ পৃঃ)। বস্ত্ততঃ হোনায়েন যুদ্ধের পরে জি‘ইর্রানাতে এসে সুরাক্বাহ মুসলমান হন (ইবনু হিশাম ১/৪৯০)। অতঃপর উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরীতে যখন মাদায়েন বিজিত হয় এবং পারস্য সম্রাট কিসরার রাজমুকুট ও অমূল্য রত্নাদি তাঁর সম্মুখে হাযির করা হয়, তখন তিনি সুরাক্বাকে ডাকেন ও তার হাতে কিসরার কংকন পরিয়ে দেন। এ সময় উমরের যবান দিয়ে বেরিয়ে যায়- الْحَمْدُ ِللهِ سِوَارَىْ كِسْرَى بْنِ هُرْمُزَ فِى يَدِ سُرَاقَةَ بْنِ مَالِكِ بْنِ جُعْشُمٍ أَعْرَابِىٌّ مِنْ بَنِى مُدْلِجٍ- ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা! আজ সম্রাট কিসরার কংকন বেদুইন সুরাক্বার হাতে শোভা পাচ্ছে’। এ বক্তব্যটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ৮৫ পৃঃ)। উক্ত বিষয়ে সহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। (খ) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে রাসূল (সাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন। কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে কিছু কথাবার্তাতেই তার মনে দারুণ রেখাপাত করে এবং সেখানেই ৭০ জন সাথী সহ তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর মাথার পাগড়ী খুলে বর্শার মাথায় বেঁধে তাকে ঝান্ডা বানিয়ে ঘোষণা প্রচার করতে করতে চললেন, قَدْ جَاءَ مَلِكُ الْأَمْنِ وَالسَّلاَمِ، لَيَمْلَأُ الدُّنْيَا عَدْلاً وَقِسْطًا ‘শান্তি ও নিরাপত্তার বাদশাহ আগমন করেছেন। দুনিয়া এখন ইনছাফ ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৯০ পৃঃ; আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল (ঐ, তা‘লীক্ব ১১৩-১১৬; আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৪৫০)। এছাড়া মানছূরপুরী রাসূল (সাঃ)-এর মু‘জেযা অধ্যায়ে বর্ণিত ২১টি ঘটনার মধ্যেও এটি আনেননি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৩৮-৬২ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, বুরাইদা আসলামী মক্কার বনু সাহম গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি হিজরতকালে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ৭০ অথবা ৮০জন সাথী সহ ইসলাম কবুল করেন। বদর অথবা ওহুদ যুদ্ধের পরে মদীনায় আগমন করেন। এরপর থেকে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে প্রায় ১৬টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হোদায়বিয়ার সফরে বায়‘আতুর রিযওয়ানে শরীক ছিলেন। তিনি প্রথমে মদীনা ও পরে বছরার অধিবাসী ছিলেন। অতঃপর ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার খিলাফতকালে (৬০-৬৪ হিঃ) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে খোরাসান গমন করেন। অতঃপর সেখানে মারভ নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র সেখানেই থেকে যান (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৩২; আল-ইস্তী‘আব)।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৪৯৪; আল-বিদায়াহ ২/২১১। উল্লেখ্য যে, ইবনু ইসহাক এখানে পরপর দু’টি খুৎবা উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ১/৫০০-০১; বায়হাক্বী দালায়েল ২/৫২৪-২৫; যাদুল মা‘আদ ১/৩৬২-৬৩ টীকাসহ)। বর্ণনা দু’টির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৫৩৬, ৫৩৭)। খুৎবা দু’টি বিভিন্ন পাঠ্য পুস্তকে এবং খুৎবার কিতাবসমূহে প্রচলিত আছে। কিন্তু তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।
[4]. আর-রাহীক্ব ১৭৩ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২০২; যাদুল মা‘আদ ১/৯৯- টীকা; ইবনু হিশাম ১/৪৯৪। লোকদের সকলের দাবীর মুখে রাসূল (সাঃ) তাদের বলেন, তোমরা উষ্ট্রীকে ছেড়ে দাও, সে আদেশপ্রাপ্ত’(خَلُّوا سَبِيلَهَا فَإِنَّهَا مَأْمُورَةٌ)। অতঃপর সে বর্তমান মসজিদে নববীর দরজার সামনে বসে পড়ে (ইবনু হিশাম ১/৪৯৫)। বর্ণনাটি যঈফ। তবে বহু সূত্রে এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের সূত্রে আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের কারণে এটি ‘হাসান লিগায়রিহি’ স্তরে উন্নীত হয়েছে’ (সীরাহ সহীহাহ ১/২১৯-টীকা)। অবশ্য তিনি যে সেখানেই অবতরণ করেছিলেন, তা মুসলিম (হা/২০৫৩ (১৭১) ও বুখারী (হা/৩৯১১) দ্বারা প্রমাণিত।

Leave a Comment

error: Don't Copy This Content !!