মহানবী (সাঃ) জীবনী – মাক্কী জীবন – অতিরঞ্জিত কাহিনী

One Time School

অতিরঞ্জিত কাহিনী
হিজরতের কাহিনীতে বহু কিছু অতিরঞ্জিত বর্ণনা যুক্ত হয়েছে। যার কোন ভিত্তি নেই। যেমন, (ক) রাসূল (সাঃ) ছওর গুহায় প্রবেশের পর আবুবকর (রাঃ) গুহাটি পরিষ্কার করলেন এবং নিজের পায়জামা ছিঁড়ে এর মধ্যেকার গর্তগুলি পূরণ করে দেন। কিন্তু দু’টি গর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি ঐ দু’টি গর্তের মুখে পা দিয়ে রাখেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাঁর উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে সাপ কিংবা বিচ্ছু আবুবকর (রাঃ)-এর পায়ে দংশন করে। এতে তিনি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) জেগে উঠবেন সেই ভয়ে নড়াচড়া করেননি। একপর্যায়ে বিষের তীব্র যন্ত্রণায় তার চোখের পানি রাসূল (সাঃ)-এর মুখে ঝরে পড়লে তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তখন রাসূল (সাঃ) নিজের মুখের লালা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলে বিষের যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। পরবর্তীতে তার বিষের ব্যথা ফিরে আসে এবং এটাই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ’।[রাযীন, মিশকাত হা/৬০২৫; আর-রাহীক্ব ১৬৪-৬৫ পৃঃ] আবুবকর ঐ সময় কাঁদছিলেন এবং বলছিলেন, আল্লাহর কসম! আমি নিজের জন্য কাঁদছিনা, বরং আমি ভয় পাচ্ছি হে রাসূল! আপনার কি হবে? এছাড়া (খ) ছওর গুহার মুখে মাকড়সার জাল বোনা, (গ) একটি বৃক্ষের জন্ম হওয়া ও রাসূল (সাঃ)-কে ঢেকে দেওয়া (ঘ) সেখানে এসে দু’টি কবুতরের বাসা বাঁধা ও তাতে ডিম পাড়া ইত্যাদি সবই বানোয়াট ও কল্পকাহিনী মাত্র।[সিলসিলা যঈফাহ হা/১১২৮-২৯; মা শা-‘আ ৮০ পৃঃ] বরং এটাই সঠিক যে, আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে তাঁদেরকে গায়েবী মদদ করেছিলেন এবং কুরায়েশদের প্রেরিত অনুসন্ধানী দলের দৃষ্টিকে আল্লাহ অন্যদিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যা আবুবকর (রাঃ)-এর বক্তব্য থেকেই বুঝা যায়। পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধে ফেরেশতা পাঠিয়ে আল্লাহ একইভাবে গায়েবী মদদ করেন (আনফাল ৮/৯)। বস্ত্ততঃ এই সাহায্য নবী ও তাঁর সনিষ্ঠ অনুসারী মুমিনগণ সর্বদা পেয়ে থাকেন।[1]

আবুবকর পরিবারের অনন্য খিদমত (خدمات فريدة لأسرة أبى بكر) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) হিজরতের প্রাক্কালে আসমা সফরের মাল-সামান ও খাদ্য-সামগ্রী বাঁধার জন্য রশিতে কম পড়ায় নিজের কোমরবন্দ খুলে তা ছিঁড়ে দু’টুকরা করে এক টুকরা দিয়ে থলির মুখ বাঁধেন ও বাকী টুকরা দিয়ে নিজের কোমরবন্দের কাজ সারেন। এ কারণে তিনি ذَاتُ النِّطَاقَيْنِ বা দুই কোমরবন্দের অধিকারিণী উপাধিতে ভূষিত হন’ (বুখারী হা/২৯৭৯)। উল্লেখ্য যে, আসমা (রাঃ) প্রতি রাতে তাঁদের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেতেন (ইবনু হিশাম ১/৪৮৫) বলে যা প্রসিদ্ধ আছে, তা সঠিক নয় (মা শা-‘আ ৭৮ পৃঃ)।
(২) বাসায় রক্ষিত পাঁচ/ছয় হাযার মুদ্রার সবই পিতা আবুবকর যাবার সময় সাথে নিয়ে যান। তাঁরা চলে যাবার পর আসমার বৃদ্ধ ও অন্ধ দাদা আবু ক্বোহাফা এসে আসমাকে বললেন, বেটি! আমি মনে করি, আবুবকর তোমাদের দ্বিগুণ কষ্টে ফেলে গেল। সে নিজে চলে গেল এবং নগদ মুদ্রা সব নিয়ে গেল। একথা শুনে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে আসমা একটা পাথর কাপড়ে জড়িয়ে টাকা রাখার গর্তে রেখে এসে দাদাকে সেখানে নিয়ে গেল এবং দাদার হাত উক্ত গর্তের মধ্যে কাপড়ের গায়ে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ দাদু! আববা সব মুদ্রা রেখে গেছেন’। অন্ধ দাদু তাতে মহা খুশী হয়ে বললেন, أَمَّا إِذَا تَرَكَ هَذَا فَنَعَمْ ‘যাক! এগুলো ছেড়ে গিয়ে সে খুব ভাল কাজ করেছে’ (হাকেম হা/৪২৬৭ সনদ সহীহ)। উল্লেখ্য যে, আবুবকর (রাঃ)-এর পিতা আবু ক্বোহাফা ঐ সময় কাফের ছিলেন। পরে তিনি মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।
(৩) তাছাড়া আসমার ছোট বোন আয়েশা আসমার সাথে সকল কাজে সাহায্য করেন।
(৪) তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ পিতার সাথে রাতে গুহায় কাটাতেন ও ভোর রাতে বাড়ি ফিরে আসতেন। অতঃপর শত্রুপক্ষের খবরাখবর নিয়ে রাতের বেলা পুনরায় গুহায় চলে যেতেন’ (বুখারী হা/৩৯০৫)।
(৫) আবুবকরের মুক্তদাস ‘আমের বিন ফুহায়রা ছওর পর্বতের পার্শ্ববর্তী ময়দানে দিনের বেলা ছাগল চরাতো। তারপর রাতের একাংশ অতিবাহিত হলে সে ছাগপাল নিয়ে ছওর পাহাড়ের পাদদেশে চলে আসত এবং রাসূল (সাঃ) ও আবুবকরকে দুধ পান করাত। তারপর সেখানে অবস্থান করে ভোর হবার আগেই ছাগপাল নিয়ে পুনরায় দূরে চলে যেত’ (বুখারী হা/৩৯০৫)।
এইভাবে দেখা যায় যে, আবুবকর (রাঃ)-এর পুরো পরিবার হিজরতের প্রস্তুততিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, সাহাবীগণের মধ্যে একমাত্র আবুবকর (রাঃ) এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন যে, তাঁর চার পুরুষ মুসলমান ও সাহাবী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি, তাঁর পিতা-মাতা, তাঁর সন্তানগণ এবং তাদের সন্তানগণ। তন্মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন তাঁর কন্যা আসমার পুত্র ও আয়েশার পালিত পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (১-৭৩ হিঃ)। যিনি ছিলেন হিজরতের পরপরই ক্বোবায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান। তাঁর সহোদর ছোট ভাই উরওয়া বিন যুবায়ের (২৩-৯৪ হিঃ) ছিলেন রাসূল চরিত বর্ণনায় শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাবী এবং মদীনার শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ সপ্তকের অন্যতম (সৈয়ূত্বী, ত্বাবাক্বাতুল হুফফায ক্রমিক ৪৯)।
আল্লাহ বলেন,رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِيْ إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নে‘মত তুমি দান করেছ, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শক্তি আমাকে দাও! আর আমি যেন এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে তুমি কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম এবং আমি তোমার একান্ত আজ্ঞাবহদের অন্তর্ভুক্ত’ (আহক্বাফ ৪৬/১৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত দো‘আটি আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) করেছিলেন, যখন তিনি ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন। ফলে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যার সকল সন্তান ও পিতা-মাতা ইসলাম কবুল করেছিলেন’ (কুরতুবী)। উল্লেখ্য যে, হযরত আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাইতে বয়সে দু’বছরের ছোট ছিলেন।

গুহা থেকে ইয়াছরিব (من الغار إلى يثرب) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
অনেক খোঁজাখুজির পর ব্যর্থ হয়ে কাফেররা একপ্রকার রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। আব্দুল্লাহর মাধ্যমে সব খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবার ইয়াছরিব যাত্রার নির্দেশ দিলেন।
১লা রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর সোমবার প্রত্যুষে তাঁরা ছওর গিরিগুহা ছেড়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে ইয়াছরিব অভিমুখে রওয়ানা হন। একটি উটে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) এবং অন্যটিতে মুক্তদাস ‘আমের বিন ফুহাইরা ও বনু দীল (الدِّيلِ) গোত্রের পথপ্রদর্শক (প্রসিদ্ধ মতে) আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত লায়ছী সওয়ার হয়, যে তখন কাফের ছিল।[ফাৎহুল বারী হা/৩৯০৫]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় আবুবকর (রাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন,أَخْرَجُوْا نَبِيَّهُمْ لَيَهْلِكُنَّ ‘তারা তাদের নবীকে বের করে দিল। এখন অবশ্যই তারা ধ্বংস হবে’। অতঃপর সূরা হজ্জ-এর ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- الَّذِيْنَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلاَّ أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللهُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيْهَا اسْمُ اللهِ كَثِيْرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’ (৩৯)। ‘যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা ‘আল্লাহ’। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে নাছারাদের বিশেষ উপাসনালয়, সাধারণ উপাসনালয়, ইহূদীদের উপাসনালয় ও মুসলমানদের মসজিদসমূহ, যে সকল স্থানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়, সবই ধ্বংস হয়ে যেত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হজ্জ ২২/৩৯-৪০)।[তিরমিযী হা/৩১৭১; আহমাদ হা/১৮৬৫; হাকেম হা/২৩৭৬] বস্ত্ততঃ এটাই ছিল যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে নাযিল হওয়া প্রথম আয়াত।

[1]. আম্বিয়া ২১/৮৮; রূম ৩০/৪৭। (১) জানা আবশ্যক যে, গুহা মুখে মাকড়সা সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তা ‘মুনকার’ বা যঈফ। যেমন রাসূল (সাঃ) আবুবকরকে বলছেন, جَزَى اللهُ عَزَّ وجَلَّ العنكبوتَ عنا خيرًا، فإنها نَسَجَتْ عليَّ وعليكَ يا أبا بكرٍ في الغار، حتَّى لَمْ يَرَنا المشركونَ ولم يَصِلُوا إلينا ‘আল্লাহ আমাদের পক্ষ হতে মাকড়সাকে উত্তম পুরস্কার দিন। কেননা সে আমার ও তোমার উপরে হে আবুবকর! গুহাতে জাল বুনেছে। ফলে মুশরিকরা আমাদের দেখতে পায়নি এবং আমাদের কাছে পৌঁছতে পারেনি’ (মুসনাদে দায়লামী; সিলসিলা যঈফাহ হা/১১৮৯, ৩/৩৩৭ পৃঃ)। শায়খ আলবানী উপরোক্ত বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, গুহার মাকড়সা ও দুই কবুতরের ডিম পাড়া সম্পর্কে যেসব লেখনী ও বক্তব্যসমূহ প্রচলিত রয়েছে, সেগুলির কিছুই সঠিক নয়’ (যঈফাহ ৩/৩৩৯; মা শা-‘আ ৮৩ পৃঃ)। (২) প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ)-কে না পেয়ে কুরায়েশ নেতারা আলী (রাঃ)-এর উপর নির্যাতন করে (আর-রাহীক্ব ১৬৫ পৃঃ, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৯৬)। বর্ণনাটি সূত্র বিহীন। আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু জাহল আবুবকরকে না পেয়ে তার কন্যা আসমা (রাঃ)-এর মুখে থাপ্পড় মারেন (আর-রাহীক্ব ১৬৫ পৃঃ)। কিন্তু এর সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ ঐ, তা‘লীক্ব ১০৮-০৯; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৫১৩।

Leave a Comment

error: Don't Copy This Content !!