মহানবী (সাঃ) জীবনী – মাক্কী জীবন – রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হিজরত

One Time School

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত
ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কা‘বায় সালাত আদায়ে বাধা ও নানাবিধ কষ্ট দানের পরেও কোনভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দমিত করতে না পেরে অবশেষে তারা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। যেটা ছিল হিজরতের প্রত্যক্ষ কারণ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কুরায়েশ নেতাদের একটি দল হিজরে (الْحِجْر) একত্রিত হয়। অতঃপর লাত, মানাত ও ‘উযযার নামে শপথ করে বলে যে, এবার আমরা মুহাম্মাদকে দেখলে একযোগে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ব এবং হত্যা না করা পর্যন্ত তাকে ছেড়ে আসব না’।
একথা জানতে পেরে ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলেন এবং উক্ত খবর দিয়ে বললেন যে, ঐ নেতারা আপনাকে হত্যা করে রক্তমূল্য নিজেরা ভাগ করে পরিশোধ করবে। রাসূল (সাঃ) বললেন, বেটি! আমাকে ওযূর পানি দাও। অতঃপর ওযূ করে তিনি সোজা হারামে চলে গেলেন ও তাদের মজলিসে প্রবেশ করলেন। তারা তাঁকে দেখে বলে উঠল, এই তো সে ব্যক্তি। কিন্তু কেউ তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে বা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে সাহস করল না। এ সময় তিনি তাদের দিকে এক মুষ্টি মাটি ছুঁড়ে মেরে বলেন, شَاهَتِ الْوُجُوهُ ‘চেহারাসমূহ ধূলি মলিন হৌক’! রাবী বলেন, ঐ মাটি যার গায়েই লেগেছিল, সেই-ই বদরের যুদ্ধে কাফের অবস্থায় নিহত হয়েছিল’।[আহমাদ হা/২৭৬২, ৩৪৮৫; হাকেম হা/৫৮৩, ৩/১৫৭; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৮২৪]
উল্লেখ্য যে, হযরত নূহ, ইবরাহীম ও মূসা (আঃ) আল্লাহর পথে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। অন্যদের মধ্যে বহুসংখ্যক নবীকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করতে সক্ষম না হলেও তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, لَقَدْ أُخِفْتُ فِى اللهِ وَمَا يُخَافُ أَحَدٌ وَلَقَدْ أُوذِيتُ فِى اللهِ وَمَا يُؤْذَى أَحَدٌ وَلَقَدْ أَتَتْ عَلَىَّ ثَلاَثُونَ مِنْ بَيْنِ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ وَمَا لِى وَلِبِلاَلٍ طَعَامٌ يَأْكُلُهُ ذُو كَبِدٍ إِلاَّ شَىْءٌ يُوَارِيهِ إِبْطُ بِلاَلٍ ‘আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে ভীত করা হয়েছে এমনটি কাউকে করা হয়নি। আমি আল্লাহর পথে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছি, এমনটি কেউ হয়নি। মাসের ত্রিশটি দিন ও রাত আমার ও আমার পরিবারের কোন খাদ্য জোটেনি। বেলালের বগলে যতটুকু লুকানো সম্ভব ততটুকু খাদ্য ব্যতীত’ (অর্থাৎ খুবই সামান্য)।[আহমাদ হা/১২২৩৩, ১৪০৮৭; তিরমিযী হা/২৪৭২; ইবনু মাজাহ হা/১৫১]
বলা বাহুল্য এভাবে চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পরেই আল্লাহ তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেন।

হিজরত শুরু (بدء الهجرة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━
১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত শেষ রাতে আবুবকর (রাঃ)-এর বাড়ী থেকে হিজরত শুরু হয়[1] এবং রাত থাকতেই তাঁরা ৩ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে ছওর গিরিগুহায় পৌঁছে যান। অতঃপর সেখানে তাঁরা শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার তিনদিন তিন রাত অবস্থান করেন। এসময় রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ৫৩ বছর।

বিবরণ (وصف الهجرة) :
━━━━━━━━━━━━━
আয়েশা (রাঃ) বলেন, হিজরতের দিন ভরদুপুরে একটা কাপড়ে মাথা ঢেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের বাড়ীতে আসেন। যেসময় সাধারণতঃ কেউ বের হয় না। তিনি এসে আবুবকরকে বললেন যে, তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমরা তখন তাঁদের সফরের জন্য দ্রুত গোছ-গাছ শুরু করে দিলাম। (বড় বোন) আসমা তার কোমরবন্দ ছিঁড়ে তার এক অংশ দিয়ে থলের মুখ বেঁধে দেন। অন্য অংশ নিজের ব্যবহারে রাখেন।
তিনি বলেন, আবুবকর আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। কেননা চারমাস পূর্বেই (অর্থাৎ ২য় বায়‘আতের পর থেকে হিজরতপূর্ব সময়ের মধ্যে) রাসূল (সাঃ) সকলকে জানিয়েছিলেন যে, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান স্বপ্নে দেখানো হয়েছে, যা কালো পাথুরে মাটির মাঝে খেজুর বাগিচা সমৃদ্ধ এলাকা। তখন থেকেই মুসলমানগণ ইয়াছরিবে হিজরত করতে থাকেন। এমনকি হাবশা থেকেও অনেকে ফিরে ইয়াছরিবে যান। তবে জা‘ফর বিন আবু তালেব তখনও সেখানে ছিলেন। এক পর্যায়ে আবুবকরও ইয়াছরিবে চলে যেতে চান। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বলেন, عَلَى رِسْلِكَ فَإِنِّى أَرْجُو أَنْ يُؤْذَنَ لِى ‘থেমে যাও! আশা করছি যে, আমাকেও অনুমতি দেওয়া হবে’ (বুখারী হা/২২৯৭; ৩৯০৫)। ফলে সেদিন থেকেই আবুবকর দু’টি দ্রুতগামী বাহন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, দু’টি বাহনের যেকোন একটি আপনি গ্রহণ করুন। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, মূল্যের বিনিময়ে (অর্থাৎ নিজস্ব বাহনেই তিনি হিজরত করতে চান)। অতঃপর তাঁরা ছওর গিরিগুহায় চলে যান ও সেখানে তিনরাত আত্মগোপনে থাকেন। সঙ্গে আমার ভাই আব্দুল্লাহ থাকত এবং ভোরের অন্ধকার থাকতেই সে চলে আসত। যাতে লোকেরা বুঝতে না পারে যে, সে বাইরে ছিল। আমাদের মুক্তদাস ‘আমের বিন ফুহায়রা দুম্বা চরাত এবং রাতের অন্ধকারে গিয়ে দুধ পান করাত। এভাবে তিনরাত কেটে যায়। অতঃপর তাঁরা বনু ‘আবদ বিন ‘আদী গোত্র থেকে একজন দক্ষ পথপ্রদর্শকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। যারা ‘আছ বিন ওয়ায়েল সাহমী গোত্রের মিত্র ছিল। ঐ ব্যক্তি (আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত্ব) কাফেরদের দ্বীনের উপর ছিল। অতঃপর তিনরাত্রির পরদিন (সোমবার) প্রত্যুষে(صُبْحَ ثَلاَثٍ) তাঁরা রওয়ানা হন। এ সময় তাঁদের সাথে ছিল ‘আমের বিন ফুহায়রা এবং পথপ্রদর্শক ব্যক্তি। যিনি তাদেরকে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে যাত্রা করেন’।
হাকেম বলেন, قَالَ الْحَاكِمُ تَوَاتَرَتِ الْأَخْبَارُ أَنَّ خُرُوجَهُ كَانَ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَدُخُولَهُ الْمَدِينَةَ كَانَ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ ‘এ কথাটি অবিরত ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা থেকে তাঁর যাত্রা ছিল সোমবারে এবং মদীনায় উপস্থিতি ছিল সোমবারে’। ইবনু হাজার বলেন,أَقَامَ فِيهِ ثَلَاثَ لَيَالٍ فَهِيَ لَيْلَةُ الْجُمُعَةِ وَلَيْلَةُ السَّبْتِ وَلَيْلَةُ الْأَحَدِ وَخَرَجَ فِي أَثْنَاءِ لَيْلَةِ الِاثْنَيْنِ ‘তিনি সেখানে তিনরাত কাটান। শনি, রবি ও সোম। অতঃপর সোমবার রাত থাকতে থাকতেই গুহা থেকে বের হয়ে রওয়ানা দেন’।[বুখারী, ফৎহসহ হা/৩৯০৫]
হিজরতের উক্ত সংকটময় রাতের কথা বলতে গিয়ে উমর (রাঃ) আল্লাহর কসম করে বলতেন, وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَتِلْكَ اللَّيْلَةُ خَيْرٌ مِنْ آلِ عُمَرَ ‘ঐ এক রাতের আমল গোটা উমর পরিবারের সারা জীবনের আমল অপেক্ষা উত্তম ছিল’।(হাকেম হা/৪২৬৮)

ষড়যন্ত্র কাহিনী (حكاية المؤامرة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
উল্লেখ্য যে, হিজরতের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কুরায়েশদের হত্যার ষড়যন্ত্রে ১৪জন নেতার বৈঠক ও সে বৈঠকে শায়খে ছান‘আর রূপ ধারণ করে ইবলীসের উপস্থিতি বিষয়ে ইবনু ইসহাকের বর্ণনা (ইবনু হিশাম ১/৪৮০-৮১) বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়।[2] উক্ত ঘটনা উপলক্ষে সূরা আনফাল ৩০ আয়াত[3] নাযিল হয় বলাটাও ঠিক নয়। কেননা সূরা আনফাল নাযিল হয়েছিল হিজরতের দেড় বছর পরে বদর যুদ্ধ উপলক্ষে। যা ২য় হিজরীর রামাযান মাসে সংঘটিত হয়। দ্বিতীয়তঃ কাফেরদের গৃহ অবরোধের মধ্য থেকে বের হবার সময় রাসূল (সাঃ) তাদের দিকে বালু নিক্ষেপ করেন। যা তাদের চোখে ও মাথায় ভরে যায় এবং তিনি এ সময় সূরা ইয়াসীনের ১-৯ আয়াতগুলি বা কেবল ৯ আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর শয়তান এসে তাদের বলে ‘আল্লাহ তোমাদের নিরাশ করুন! মুহাম্মাদ বেরিয়ে গেছে’।[ইবনু হিশাম ১/৪৮২-৮৪; আর-রাহীক্ব ১৬৩ পৃঃ] এটির সনদ ‘মুরসাল’। যা গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া কুরায়েশরা কিভাবে জানল যে, ঐ রাতে রাসূল (সাঃ) হিজরত করবেন। আর আবুবকর (রাঃ) ছিলেন তার নিজের বাড়ীতে। তাহলে দু’জন কিভাবে একত্রিত হয়ে ছওর গুহায় চলে গেলেন? অথচ আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে বুঝা যায় যে, আবুবকর (রাঃ)-এর গৃহ থেকেই তাঁরা পৃথক বাহনে করে রওয়ানা হয়েছিলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, কুরায়েশদের ষড়যন্ত্র কাহিনী যদি সত্য হবে, তাহলে রাসূল (সাঃ)-এর নিজ গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব ছিল কোথায়? সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি চাচা আববাস, যিনি আক্বাবায়ে কুবরার বায়‘আতে উপস্থিত ছিলেন এবং হিজরতের পর ভাতিজার নিরাপত্তা দানের ব্যাপারে ইয়াছরেবী প্রতিনিধি দলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তিনি তখন কোথায় ছিলেন? (মা শা-‘আ ৭২-৭৬ পৃঃ)। বরং এটাই সঠিক যে, উপরোক্ত নেতাগণ রক্তপিপাসু দুশমন ছিলেন। আর সে কারণেই রাসূল (সাঃ) গোপনে হিজরত করেন এবং আলী ইবনু আবী ত্বালিবকে রেখে আসেন। তিনি সেখানে তিন দিন তিন রাত অবস্থান করেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে যার যা আমানত ছিল, সব তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। অতঃপর তিনি হিজরত করে মদীনায় যান ও রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন।[আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১৫৪৬, ৫/৩৮৪ পৃঃ]

গৃহ থেকে গুহা -কিছু ঘটনা (من الدار إلى الغار : بعض الحادثات) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
মক্কা ত্যাগকালে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিক্রিয়া(تأثير الرسول صـ عند مغادرة مكة) :
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন হাজূনে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসী ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, وَاللهِ إِنَّكِ لَخَيْرُ أَرْضِ اللهِ وَأَحَبُّ أَرْضِ اللهِ إِلَى اللهِ وَلَوْلاَ أَنِّى أُخْرِجْتُ مِنْكِ مَا خَرَجْتُ ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জনপদ ও আল্লাহর নিকট আল্লাহর মাটিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাটি। যদি আমাকে তোমার থেকে বের করে না দেওয়া হত, তাহলে আমি বেরিয়ে যেতাম না’।[তিরমিযী হা/৩৯২৫; আহমাদ হা/১৮৭৩৯]
এ প্রসঙ্গে যে আয়াতটি নাযিল হয় তা নিম্নরূপ-
وَكَأَيِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ هِيَ أَشَدُّ قُوَّةً مِّنْ قَرْيَتِكَ الَّتِيْ أَخْرَجَتْكَ أَهْلَكْنَاهُمْ فَلاَ نَاصِرَ لَهُمْ-
‘যে জনপদ তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চাইতে কত শক্তিশালী জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি। অতঃপর তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৩)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আয়াতটি হিজরতকালে মক্কা ত্যাগের সময় নাযিল হয়।[4]
গুহার মুখে শত্রুদল(الأعداء على الغار) :
রাসূল (সাঃ)-কে না পেয়ে কুরায়েশরা চারিদিকে অনুসন্ধানী দল পাঠায় এবং ঘোষণা করে যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও আবুবকরকে বা দু’জনের কাউকে জীবিত বা মৃত ধরে আনবে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে।[ইবনু হিশাম ১/৪৮৯, বুখারী হা/৩৯০৬] সন্ধানী দল এক সময় ছওর গিরিগুহার মুখে গিয়ে পৌঁছে। এ সময়কার অবস্থা আবুবকর (রাঃ) বর্ণনা করেন এভাবে যে,نَظَرْتُ إِلَى أَقْدَامِ الْمُشْرِكِينَ عَلَى رُؤُوسِنَا وَنَحْنُ فِى الْغَارِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ نَظَرَ إِلَى قَدَمَيْهِ أَبْصَرَنَا تَحْتَ قَدَمَيْهِ فَقَالَ يَا أَبَا بَكْرٍ مَا ظَنُّكَ بِاثْنَيْنِ اللهُ ثَالِثُهُمَا ‘গুহায় থাকা অবস্থায় আমি আমাদের মাথার উপরে তাদের পাগুলি দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাদের কেউ নীচের দিকে তাকায়, তাহলে আমাদেরকে তার পায়ের নীচে দেখতে পাবে। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, দু’জন ধারণা করছ কেন? আল্লাহ আছেন তৃতীয় হিসাবে’।[বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৮১; মিশকাত হা/৫৮৬৮] বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে-
إِلاَّ تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَار إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌِ- (التوبة ৪০)-
‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিষ্কার করেছিল দু’জনের হিসাবে। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল। যখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি। আর আল্লাহ কাফেরদের শিরকী কালেমা নীচু করে দিলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহর তাওহীদের কালেমা সদা উন্নত। আল্লাহ হলেন পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ঐ সময়ের ঐ নাযুক অবস্থায় لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا (চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন), এই ছোট্ট কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণরূপে কায়মনোচিত্তে নিজেকে আল্লাহর উপরে সোপর্দ করে দেন। দুনিয়াবী কোন উপায়-উপকরণের উপরে নির্ভরশীল ব্যক্তির পক্ষে এরূপ কথা বলা আদৌ সম্ভব নয়।
বস্ত্ততঃ একথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন সংকটকালে আরও কয়েকবার বলেছেন। এখানে ‘অদৃশ্য বাহিনী’ বলতে ফেরেশতাগণ হতে পারে কিংবা অন্য কোন অদৃশ্য শক্তি হতে পারে, যা মানুষের কল্পনার বাইরে। মূলতঃ সবই আল্লাহর বাহিনী। সবচেয়ে বড় কথা, সারা পাহাড় তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর গুহা মুখে পৌঁছেও তারা গুহার মধ্যে খুঁজল না, এমনকি নীচের দিকে তাকিয়েও দেখল না। তাদের এই মনের পরিবর্তনটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল সরাসরি গায়েবী মদদ এবং রাসূল (সাঃ)-এর অন্যতম মো‘জেযা। আল্লাহ বলেন, وَمَا يَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّكَ إِلاَّ هُوَ ‘তোমার প্রভুর সেনাবাহিনীর খবর তোমার প্রভু ব্যতীত কেউ জানে না’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১)। আর একারণেই হাযারো প্রস্তুততি নিয়েও অবশেষে কুফরীর ঝান্ডা অবনমিত হয় ও তাওহীদের ঝান্ডা সমুন্নত হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল’ (নাহল ১৬/১২৮)।

[1]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৩৬৭; আর-রাহীক্ব ১৬৩-৬৪ পৃঃ। ইবনু হাজার ১লা রবীউল আউয়াল বৃহস্পতিবার বলেছেন (ফাৎহুল বারী হা/৩৮৯৬-এর পরে ‘রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের মদীনায় হিজরত’ অনুচ্ছেদ)। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাব মতে ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার হয়। আমরা আধুনিক গবেষক সুলায়মান মানছূরপুরীর হিসাবকেই অগ্রাধিকার দিলাম।
[2]. উক্ত ১৪ জন নেতার নাম নিম্নরূপ:(১) বনু মাখযূম গোত্রের আবু জাহল বিন হিশাম। বনু নওফাল বিন ‘আব্দে মানাফ গোত্রের (২) জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম (৩) তু‘আইমাহ বিন ‘আদী (৪) হারেছ বিন ‘আমের। বনু ‘আব্দে শামস বিন ‘আব্দে মানাফ গোত্রের (৫) উৎবাহ ও (৬) শায়বাহ বিন রাবী‘আহ (৭) আবু সুফিয়ান বিন হারব। বনু ‘আব্দিদ্দার গোত্রের (৮) নাযার বিন হারেছ। বনু আসাদ বিন আব্দুল ওযযা গোত্রের (৯) আবুল বাখতারী বিন হিশাম (১০) যাম‘আহ ইবনুল আসওয়াদ (১১) হাকীম বিন হেযাম। বনু সাহম গোত্রের (১২) নুবাইহ ও (১৩) মুনাবিবহ ইবনুল হাজ্জাজ। বনু জুমাহ গোত্রের (১৪) উমাইয়া বিন খালাফ (ইবনু হিশাম ১/৪৮১; আর-রাহীক্ব ১৫৯ পৃঃ)।
[3]. وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ- ‘স্মরণ কর, যখন (মক্কার) কাফেররা (দারুন নাদওয়াতে বসে) তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তোমাকে বন্দী করার জন্য অথবা হত্যা করার জন্য অথবা বের করে দেবার জন্য (কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি)। বস্ত্ততঃ তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ্ও কৌশল করেন। আর আল্লাহই শ্রেষ্ঠ কৌশলী’ (আনফাল ৮/৩০)।
[4]. তাফসীর ত্বাবারী ২৬/৩১ পৃঃ হা/৩১৩৭২। নাযিলের কারণ অংশটুকু বাদে হাদীছ সহীহ; তাহকীক তাফসীর কুরতুবী হা/৫৫১১ সূরা মুহাম্মাদ ১৩ আয়াত।
এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (সাঃ) দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ إِنَّكَ أَخْرَجْتَنِيْ مِنْ أَحَبِّ الْبِلاَدِ إِلَيَّ فَأَسْكِنِّيْ أَحَبَّ الْبِلاَدِ إِلَيْكَ فَأَسْكَنَهُ اللهُ الْمَدِيْنَةَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় জনপদ থেকে বের করে এনেছ। অতএব তুমি আমাকে তোমার সর্বাধিক প্রিয় স্থানে বসবাস করাও। অতঃপর আল্লাহ তাকে মদীনাতে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন’ (হাকেম হা/৪২৬১, ৩/৪)। হাদীছটি মওযূ‘ বা জাল। বরং সহীহ হাদীছ এই যে, তিনি হাজূনে দাঁড়িয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে (তিরমিযী হা/৩৯২৫; হাদীছ সহীহ)। ইবনু আব্দিল বার্র মালেকী বলেন, আমি বিস্মিত হই সহীহ হাদীছ ছেড়ে কিভাবে মানুষ মওযূ‘ হাদীছের ভিত্তিতে এভাবে তাবীল করতে পারে’। অথচ এটি প্রসিদ্ধ যে, মালেকীগণ মক্কার উপরে মদীনাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন (মা শা-‘আ ৮৩-৮৪ পৃঃ)।

Leave a Comment

error: Don't Copy This Content !!