মহানবী (সাঃ) জীবনী – মাক্কী জীবন – ইসরা ও মি‘রাজ

One Time School

ইসরা ও মি‘রাজ
‘ইসরা’ অর্থ নৈশ ভ্রমণ এবং ‘মি‘রাজ’ অর্থ সিঁড়ি। মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ পর্যন্ত বোরাক্বের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্বল্পকালীন নৈশ ভ্রমণকে ‘ইসরা’ (الإِسْرَاء) বলা হয় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশের সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকে মে‘রাজ (الْمِعْرَاج) বলা হয়। নববী জীবনে এটি ছিল এক অলৌকিক ও শিক্ষাপ্রদ ঘটনা। যার মাধ্যমে শেষনবীকে পরকালীন জীবনের সবকিছু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করানো হয়। এর ফলে তাঁর মধ্যে যেমন বিশ্বাস ও প্রতীতি দৃঢ়তর হয় এবং হৃদয়ে প্রশান্তি জন্মে, তেমনি মুমিন হৃদয়ে পরকালীন মুক্তির জন্য উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। ভবিষ্যৎ মাদানী জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতসংকুল জিহাদী যিন্দেগীতে যে দৃঢ় বিশ্বাস-এর প্রয়োজন হবে অত্যন্ত বেশী। সেকারণ অদূর ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য হিজরতের পূর্বেই আল্লাহ তাঁর নবীকে মে‘রাজের মাধ্যমে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেন। যাতে তা মাদানী জীবনে ইসলামী বিজয়ে সহায়ক হয়। পবিত্র কুরআনে সূরা বনু ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ পর্যন্ত ৬ আয়াতে মি‘রাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। বাকী বিশদ ঘটনাবলী সহীহ হাদীছ সমূহে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ ‘পরম পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রির একাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার চতুষ্পার্শ্বকে আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)।
উক্ত আয়াতে চারটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে।

১. ইসরা ও মি‘রাজের পুরা ঘটনাটি রাতের শেষাংশে স্বল্প সময়ে একবার মাত্র সম্পন্ন হয়েছিল, যা ليلاً শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে।
২. ঘটনাটি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ঘটেছিল, যাبِعَبْدِهِ শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে। কেননা রূহ ও দেহের সমন্বিত সত্তাকে ‘আব্দ’ বা দাস বলা হয়। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নযোগে বা রূহানী কোন ব্যাপার হলে কেউ একে অবিশ্বাস করত না এবং কুরআনে তাঁকে ‘আব্দ’ না বলে হয়তবা ‘রূহ’ (بِرُوْحِ عَبْدِهِ) বলা হত। এখানে عَبْدُهُ ‘তাঁর দাস’ বলে রাসূল (সাঃ)-কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেননা আল্লাহর দাস হওয়ার মধ্যেই মানুষের সর্বোচ্চ সম্মান নিহিত রয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, هِىَ رُؤْيَا عَيْنٍ أُرِيَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘এটি ছিল প্রত্যক্ষ দর্শন, যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখানো হয়েছিল’ (বুখারী হা/৪৭১৬)।
উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ঘোড়া বা উটে যাতায়াতে দু’মাসের পথ। যা এক রাতেই ভ্রমণ করে মি‘রাজ থেকে ফিরে এসে সকাল বেলা যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লোকদের কাছে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন সবাই একে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল। অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন, এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব পেয়ে তারা চুপ হল বটে। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত আবুবকর (রাঃ) একথা শোনামাত্র বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং বলেন, نَعَمْ، إِنِّي لَأُصَدِّقُهُ فِيْمَا هُوَ أَبْعَدُ مِنْ ذَلِكَ، أُصَدِّقُهُ بِخَبَرِ السَّمَاءِ فِي غَدْوَةِ أَوْ رَوْحَةِ. فَلِذَلِكَ سُمِّيَ أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقَ ‘আমি তাকে এর চাইতে অনেক বড় বিষয়ে সত্য বলে জানি। আমি সকালে ও সন্ধ্যায় তার নিকটে আগত আসমানী খবরসমূহকে সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি’। এ দিন থেকেই তিনি ‘ছিদ্দীক্ব’ (صِدِّيْق) বা সর্বাধিক সত্যবাদী নামে অভিহিত হতে থাকেন’।[1]
এটি অত্যন্ত বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল। সেকারণ শুরুতে سُبْحَانَ বিস্ময়সূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাপার হলে তো এটা মোটেই আশ্চর্যজনক হত না এবং একদল দুর্বল ঈমানদার ইসলাম ত্যাগ করে চলে যেত না। এজন্যই আল্লাহ এটাকে ‘মানুষের জন্য ফিৎনা বা পরীক্ষা স্বরূপ’ (فِتْنَةً لِلنَّاسِ) বলেছেন (ইসরা ১৭/৬০)। অর্থাৎ উক্ত ঘটনায় নও মুসলিমদের মুরতাদ হয়ে যাবার ফিৎনা। যেমন অনেকে হয়েছিল।[ইবনু হিশাম ১/৩৯৮; হাকেম হা/৪৪০৭, ৩/৬২]
৩. বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর আশপাশ ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তীন সহ পুরা সিরিয়া অঞ্চল বরকতময় এলাকা, যা بَارَكْنَا حَوْلَهُ বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। এখানে আধ্যাত্মিক বরকত হল এই যে, হযরত ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকূব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) সহ বনু ইস্রাঈলের হাযার হাযার নবীর আবাসভূমি হল এই এলাকা। আর দুনিয়াবী বরকত এই যে, শাম এলাকার মাটি মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে উর্বর ও সুজলা-সুফলা। এতদ্ব্যতীত এ অঞ্চলের অন্যান্য বরকত সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[2]
৪. আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শন সমূহের কিছু অংশ স্বচক্ষে দেখিয়ে দেন। যা لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। উক্ত নিদর্শন সমূহের মধ্যে ছিল যা সহীহ হাদীছসমূহে বর্ণিত হয়েছে, যেমন (১) মক্কা থেকে বোরাকে সওয়ার হওয়ার পূর্বে সীনা চাক করা এবং তা যমযম পানি দিয়ে ধুয়ে সেখানে নূর দিয়ে ভরে দেওয়া। অতঃপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস গিয়ে সেখান থেকে ঊর্ধ্বারোহণের পূর্বে তাঁকে দুধ ও মদ পরিবেশন করা। কিন্তু রাসূল (সাঃ) দুধ গ্রহণ করেন। তখন জিব্রীল বলেন, أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ ‘আপনি স্বভাবধর্ম প্রাপ্ত হয়েছেন’। (২) তিনি প্রথম আসমানে আদম, দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারূণ, ষষ্ঠ আসমানে মূসা এবং সপ্তম আসমানে ইবরাহীম (‘আলাইহিমুস সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তবে আদম ও ইবরাহীম (আঃ) ব্যতীত অন্যদের আসমানের ব্যাপারে বর্ণনাগত ভিন্নতা রয়েছে। (৩) তিনি ফেরেশতাদের কলম দিয়ে লেখার খসখস আওয়ায শোনেন। (৪) ছয়শো ডানাবিশিষ্ট জিব্রীলকে তার নিজস্ব রূপে নিকট থেকে দেখেন। (৫) সিদরাতুল মুনতাহার কুলগাছ দেখেন। যার পাতাগুলি হাতির কানের মত বড় বড়। (৬) সপ্তম আসমানে বায়তুল মা‘মূর মসজিদ দেখেন। যেখানে প্রতিদিন সত্তুর হাযার ফেরেশতা সালাত আদায় করে। কিন্তু পুনরায় আর সুযোগ পায় না। (৭) হাউয কাওছার, জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। তিনি জান্নাতের নে‘মতরাজি ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। (৮) তাঁকে তাঁর জন্য নির্ধারিত সুফারিশের স্থান ‘মাক্বামে মাহমূদ’ দেখানো হয়। (৯) সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলে চারদিকে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরি মধ্যে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি অহি-র মাধ্যমে কথা বলেন। অতঃপর তাঁর উম্মতের জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়। পরে মূসার পরামর্শক্রমে তাঁর বারবার যাতায়াত ও উপর্যুপরি অনুরোধে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়। যা পঞ্চাশ ওয়াক্তের নেকীর সমান। (১০) তিনি সরাসরি আল্লাহকে দেখেননি, তাঁর নূর দেখেছিলেন। (১১) অতঃপর তিনি নেমে আসেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে নবীগণের সালাতে ইমামতি করেন। অতঃপর বোরাকে চড়ে রাত্রি কিছু বাকী থাকতেই মক্কায় মাসজিদুল হারামে ফিরে আসেন (তাফসীর ইবনু কাছীর)।[বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬৪, ১৭৮; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬] পুরা ঘটনাটিই ঘটে অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে। যা ছিল মানবীয় জ্ঞানের বহির্ভূত। অথচ বাস্তব সত্য। যা মক্কার মুশরিক ও শত্রুনেতাদের দ্বারা সত্যায়িত।
উল্লেখ্য যে, অন্যান্য নবীদেরকেও আল্লাহ তাঁর কিছু কিছু নিদর্শন দেখিয়েছেন। তবে সেগুলি সব দুনিয়াতেই দেখানো হয়েছিল। যেমন ইবরাহীম (আঃ) চারটি পাখি যবহ ও টুকরা টুকরা করে মিশ্রিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি চারটি পাহাড়ে রেখে এসে বিসমিল্লাহ বলে ডাক দিতেই তাদের স্ব স্ব দেহে পুনর্জীবিত হওয়া, অতঃপর তাঁর কাছে চলে আসা (বাক্বারাহ ২/২৬০); তাঁর জন্য নমরূদের অগ্নিকুন্ড শান্তিময় স্থানে পরিণত হওয়া (আম্বিয়া ২১/৬৮-৭০); কেন‘আন থেকে মিসর যাওয়ার পথে অপহৃত স্ত্রী সারাহ-এর উপরে যালেম বাদশাহ্র হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া (বুখারী হা/২২১৭; আহমাদ হা/৯২৩০) ইত্যাদি অলৌকিক ঘটনাবলী। অন্যদিকে মূসা (আঃ)-এর আল্লাহর সাথে পবিত্র তুবা উপত্যকায় কথোপকথন ও তূর পাহাড়ে তাঁর জ্যোতি প্রদর্শন (আ‘রাফ ৭/১৪৩), অলৌকিক লাঠির মাধ্যমে নদী বিভক্ত হওয়া ও ফেরাঊন বাহিনী ডুবে মরা (শো‘আরা ২৬/৬৩-৬৬), নিজ গোত্রের ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির এলাহী গজবে মৃত্যুবরণ ও পরক্ষণেই মূসা (সাঃ)-এর দো‘আয় ও আল্লাহর হুকুমে পুনরায় জীবিত হওয়া (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬) ইত্যাদি ঘটনাবলী।
ইবরাহীম (আঃ)-কে দেখানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَكَذَلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ ‘আর এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব প্রদর্শন করেছি। যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। অনুরূপভাবে মূসা (আঃ)-কে দেখানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى ‘যাতে আমি তোমাকে বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি’ (ত্বোয়াহা ২০/২৩)। সবশেষে শেষনবী (সাঃ)-কে সপ্তাকাশের উপরে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আল্লাহ তাঁকে পরজগতের অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করালেন এবং বললেন, لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ‘এটা এজন্য, যাতে আমি তাকে কিছু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করাই’ (ইসরা ১৭/১)।
এভাবে মে‘রাজের মাধ্যমে আল্লাহ শেষনবীর মধ্যে ‘আয়নুল ইয়াক্বীন’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দর্শনলব্ধ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেন। যা অন্য কোন নবীর বেলায় করেননি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দলীল। সেই সাথে এটি ছিল বিশ্বাসীদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلاَّ فِتْنَةً لِلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ وَنُخَوِّفُهُمْ فَمَا يَزِيدُهُمْ إِلاَّ طُغْيَانًا كَبِيرًا-(الإسراء 60)-
‘আর আমি তোমাকে (মে‘রাজের রাতে) যে দৃশ্য দেখিয়েছি এবং কুরআনে বর্ণিত যে অভিশপ্ত (যাক্কুম) বৃক্ষ দেখিয়েছি, তা ছিল কেবল মানুষের (ঈমান) পরীক্ষার জন্য। আমি তাদের ভীতি প্রদর্শন করি। অতঃপর এটা তাদের বড় ধরনের অবাধ্যতাই কেবল বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৬০)।

মে‘রাজের তারিখ (تاريخ المعراج) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এ সম্পর্কে বিদ্বানগণের মধ্যে ছয় প্রকার মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। যথা- (১) ১ নববী বর্ষেই মে‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল (২) ৫ নববী বর্ষে (৩) ১০ নববী বর্ষের ২৭শে রজব তারিখে (৪) ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে (৫) ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে (৬) ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (আর-রাহীক্ব ১৩৭ পৃঃ)।
উপরোক্ত ছয়টি মতামতের মধ্যে প্রথম চারটি গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও তৃতীয় মতটিই উপমহাদেশে প্রচলিত আছে। কারণ, এ ব্যাপারে সকল বিদ্বান একমত যে, উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এটাও সকল বিদ্বান কর্তৃক স্বীকৃত যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১০ নববী বর্ষের রামাযান মাসে। অতএব মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে একথা একপ্রকার নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। এক্ষণে শেষের তিনটি মতামতের মধ্যে কোনটিতেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তবে সূরা ইসরার শুরুতে মে‘রাজ সম্পর্কিত বর্ণনার পরপরই বনু ইস্রাঈলের অধঃপতন সম্পর্কিত বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, ঈমানী বিশ্বে বনু ইস্রাঈলের দীর্ঘ নেতৃত্বের অবসান এবং মুহাম্মাদী নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। যা ১৩ নববী বর্ষের যেকোন এক রাতে হয়েছিল বলে একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অতঃপর হিজরত শুরু হয়েছিল ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার।
মে‘রাজের সঠিক তারিখ উম্মতের নিকটে অস্পষ্ট রাখার তাৎপর্য সম্ভবতঃ এই যে, তারা যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিগত উম্মতগুলির ন্যায় অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয়ে পড়ে। বরং মে‘রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। অতঃপর মে‘রাজের অমূল্য তোহ্ফা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করে।
আল্লাহ ইচ্ছা করলে মক্কা থেকেই সরাসরি মে‘রাজ করাতে পারতেন। কিন্তু মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নিয়ে এসে সেখান থেকে মে‘রাজ করানোর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইবরাহীমী দাওয়াতের দু’টি প্রধান কেন্দ্র কা‘বা ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস দুই স্থানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এখন থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর উম্মতের উপরেই ন্যস্ত করা হবে। যা উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরী সনে সম্পন্ন হয় এবং যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও পাশ্চাত্য বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাহির থেকে ইহূদীদের এনে ফিলিস্তীনের একাংশ থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা মুসলমানদের বের করে দিয়েছে এবং সেখানে ইহূদীদের যবরদস্তি বসিয়ে দিয়ে তাকে ‘ইস্রাঈল রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে ১৯৪৮ সালে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অস্থায়ী বিষয়। যার সত্বর অবসান হবে ইনশাআল্লাহ।
অতএব ইসলামী দাওয়াতের প্রথম পর্যায় মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইয়াছরিবে হিজরতের প্রাক্কালে মে‘রাজ হয়েছিল বলা চলে। অর্থাৎ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত ১ম ও ২য় বায়‘আত অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী কোন এক রজনীতে মে‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
অতএব মে‘রাজ ছিল ইসলামী বিজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং মাদানী জীবনের নব অধ্যায়ের সূচক ঘটনা।

[1]. হাকেম হা/৪৪০৭, ৩/৬২; সহীহাহ হা/৩০৬; ইবনু ইসহাক বলেন, এ সময় রাসূল (সাঃ) তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ বলে অভিহিত করেন।-قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَبِي بَكْرٍ: وَأَنْتَ يَا أَبَا بَكْرٍ الصِّدِّيقُ، فَيَوْمَئِذٍ سَمَّاهُ الصِّدِّيقَ (ইবনু হিশাম ১/৩৯৯)। হাদীছ সহীহ, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৯২)।
[2]. দ্রঃ মিশকাত ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়-৩০ ‘ইয়ামন, শাম ও ওয়ায়েস ক্বারনীর বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ-১৩।

Leave a Comment

error: Don't Copy This Content !!