আবু ত্বালিবের মৃত্যু
১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে ঠিক তিন বছরের মাথায় বয়কট শেষ হওয়ার ৬ মাস পরে রজব মাসে আবু ত্বালিবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে আবু জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া প্রমুখ মুশরিক নেতৃবৃন্দ তাঁর শিয়রে বসে ছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যুপথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় চাচাকে বললেন, يَا عَمِّ قُلْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ كَلِمَةً أَشْهَدُ لَك بِهَا عِنْدَ اللهِ ‘হে চাচাজী! আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি তার কারণে আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে সাক্ষ্য দান করতে পারি’। জবাবে আবু ত্বালিব বলেন, ‘হে ভাতিজা! যদি আমার পরে তোমার বংশের উপর গালির ভয় না থাকত এবং কুরায়েশরা যদি এটা না ভাবত যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে এটা বলেছি ও তোমাকে খুশী করার জন্য বলেছি, তাহলে আমি অবশ্যই ওটা বলতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৮)। অতঃপর যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন আবু জাহল ও তার সহোদর বৈপিত্রেয় ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বারবার তাঁকে উত্তেজিত করতে থাকেন এবং বলেন, أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطّلِبِ؟ ‘আপনি কি আব্দুল মুত্ত্বালিবের ধর্ম ত্যাগ করবেন’? জবাবে আবু ত্বালিবের মুখ দিয়ে শেষ বাক্য বেরিয়ে যায়, أَنَا عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ ‘আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের দ্বীনের উপরে’ (আর-রাউযুল উনুফ ২/২২৩)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে উঠলেন, لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْهُ ‘আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাব। যতক্ষণ না আমাকে নিষেধ করা হয়’। ফলে আয়াত নাযিল হয়- مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْ يَّسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْا أُوْلِيْ قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيْمِ- ‘নবী ও ঈমানদারগণের জন্য সিদ্ধ নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করুক মুশরিকদের জন্য। যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (তওবা ৯/১১৩)।
এরপর রাসূল (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে আয়াত নাযিল হয়, إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَآءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পার না যাকে তুমি ভালবাসো। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে থাকেন। আর তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।[বুখারী হা/১৩৬০, ৩৮৮৪, ৪৭৭২; মুসলিম হা/২৪] উল্লেখ্য যে, সূরা তওবাহ মাদানী সূরা হলেও তার মধ্যে ১১১-১১৩ আয়াত তিনটি বায়‘আতে কুবরা ও আবু তালিবের মৃত্যু প্রসঙ্গে মক্কায় নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
এভাবে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা স্বীয় ভাতিজাকে সবকিছুর বিনিময়ে আমৃত্যু আগলে রেখেও শেষ মুহূর্তে এসে পরকালীন সৌভাগ্যের পরশমণি হাতছাড়া হয়ে গেল। স্নেহসিক্ত ভাতিজার প্রাণভরা আকুতি ব্যর্থ হল এবং শয়তানের প্রতিমূর্তি গোত্রনেতাদের প্ররোচনা জয়লাভ করল। পিতৃধর্মের বহুত্ববাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় হলেন। এ দৃশ্য যে রাসূল (সাঃ)-এর জন্য কত বেদনাদায়ক ছিল, তা আখেরাতে বিশ্বাসী প্রকৃত মুমিনগণ উপলব্ধি করতে পারেন। কেননা যে চাচা দুনিয়াবী কারাগারের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা থেকে সর্বদা ঢালের মত তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং নিজে অমানুষিক কষ্ট ও দুঃখ সহ্য করেছেন, সেই চাচা দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের পরে পুনরায় জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবেন, এটা তিনি কিভাবে ভাবতে পারেন? বলা বাহুল্য এভাবেই সর্বদা তাক্বদীর বিজয়ী হয়ে থাকে।
একদিন চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আখেরাতে আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা আযাবপ্রাপ্ত হবেন আবু ত্বালিব। তিনি আগুনের দু’টি জুতা পরিহিত হবেন, যাতে তাঁর মাথার মগয গলে টগবগ করে ফুটবে’।[1] প্রিয় চাচা আববাস (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আবু তালেব আপনাকে যেভাবে হেফাযত ও সহযোগিতা করেছেন, তার বিনিময়ে আপনি কি তাঁকে কোন উপকার করতে পারবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি তাকে জাহান্নামের গভীরে দেখতে পেলাম। অতঃপর তাকে (আল্লাহর হুকুমে) সেখান থেকে বের করে টাখনু পর্যন্ত উঠিয়ে আনলাম।وَلَوْلاَ أَنَا لَكَانَ فِى الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ ‘যদি আমি না হতাম, তাহলে তিনি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকতেন’ (মুসলিম হা/২০৯)। আবু সাঈদ খুদরীর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, সম্ভবতঃ ক্বিয়ামতের দিন আমার সুফারিশ তার উপকারে আসবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামের অগভীর স্থানে নেওয়া হবে, যা তার টাখনু পর্যন্ত পৌঁছবে এবং তাতেই তার মস্তিষ্ক আগুনে টগবগ করে ফুটবে, যেমন উত্তপ্ত কড়াইয়ে পানি ফুটে থাকে’।[2]
অতএব আবু তালিবের এই হালকা আযাব তার আমলের কারণে নয়, বরং তা হবে রাসূল (সাঃ)-এর বিশেষ সুফারিশের কারণে। আর সেটা হবে রাসূল (সাঃ)-এর বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত ও তার উচ্চ মর্যাদার কারণে, যা আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। কেননা আবু ত্বালিব শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَاءُ ‘আল্লাহ শিরকের পাপ ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে চান, তার সব পাপ ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তিনি বলেন, فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِيْنَ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুশরিকদের জন্য সুফারিশকারীদের কোন সুফারিশ কাজে আসবে না’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৪৮)।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
━━━━━━━━━━━━
১. হক-এর স্বীকৃতি এবং হকপন্থীর প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতাই কেবল পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না আক্বীদার পরিবর্তন ঘটে এবং মৌখিক স্বীকৃতি থাকে।
২. আদর্শগত ভালোবাসাই পরকালে বিচার্য বিষয়, অন্য কোন ভালোবাসা নয়। মুহাম্মাদ-এর প্রতি আবু ত্বালিবের ভালোবাসা ছিল বংশগত কারণে। আদর্শগত কারণে নয়। সেকারণ তা পরকালে কোন কাজে আসেনি।
৩. তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত হলে কোন নেক আমলই আল্লাহর নিকটে কবুল হয় না। যেমন আল্লাহর উপরে বিশ্বাস ও তাকে স্বীকৃতি দান করা সত্ত্বেও অসীলা পূজার শিরক থাকার কারণে আবু ত্বালিবের কোন সৎকর্মই আল্লাহ কবুল করেননি। বর্তমান যুগেও যেসব মুসলিম নর-নারী বিভিন্ন কবর, ছবি-প্রতিকৃতি ও স্থানপূজায় লিপ্ত আছেন ও তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তি কামনা করেন, তাদের এই কামনা জাহেলী আরবদের লালিত শিরকের সাথে তুলনীয়। যা পরকালে কোন কাজে আসবেনা।
৪. পিতৃধর্মে ত্রুটি থাকলে তা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে এবং সর্বাবস্থায় নির্ভেজাল তাওহীদকে অাঁকড়ে থাকতে হবে। সকল আবেদন-নিবেদন সরাসরি আল্লাহর নিকটেই করতে হবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কেবল তাঁর বিধানই মেনে চলতে হবে। কিন্তু অসীলা পূজারী মুশরিকরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের ধারণায় তাদের কল্পিত অসীলাকেই মুখ্য মনে করে। তার কাছেই সব আবেদন-নিবেদন পেশ করে এবং নিজেদের মনগড়া শিরকী বিধান সমূহ মেনে চলে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই বংশীয় রেওয়াজের প্রতি আকর্ষণ আবু ত্বালেব ছাড়তে পারেননি।
৫. কেবল আব্দুল্লাহ, আবু ত্বালেব ইত্যাদি ইসলামী নাম পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ না সমস্ত মনগড়া মা‘বূদ ছেড়ে একমাত্র হক মা‘বূদ আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি একনিষ্ঠ হবে। মৃত্যুর সময় আবু ত্বালিবকে শিরকের দিকে প্ররোচনা দানকারী অন্যতম নেতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ। অতএব ইসলামী নাম রাখার সাথে সাথে ইসলামী বিধান সমূহ মেনে চলা এবং আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক না করে নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাসের উপরে দৃঢ় থাকার উপরেই পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে।
[1]. মুসলিম হা/২১২; মিশকাত হা/৫৬৬৮ ‘জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ (মিশকাতে ‘বুখারী’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বুখারীতে আবু ত্বালিব-এর কথা পাওয়া যায়নি)।
[2]. মুসলিম হা/২১০, ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘আবু তালিবের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর সুফারিশ ও সেকারণে তার শাস্তি লঘু করণ’ অনুচ্ছেদ-৯০।